তারেক রহমানের সাজা নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি,পরস্পরবিরোধী কর্মসূচি
2016.07.22
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে এই প্রথম সাজা দেওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গন কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিএনপি ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন এই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচি দিয়েছে। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ তারেককে লন্ডন থেকে ঢাকায় এনে রায় কার্যকর করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
নিম্ন আদালতের বিচার পর্যালোচনা করে প্রায় আড়াই বছর পর উচ্চ আদালত গত বৃহস্পতিবার তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, অধিকাংশ নেতাই বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত। বিএনপির শীর্ষ তিন নেতার বিরুদ্ধে মোট মামলা আছে ২৪৫টি। এর মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে ২৯টি; তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৩০টি, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা আছে।
“এভাবে একের পর এক মামলা করে সরকার অন্যায় করছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। দেশবাসী এসব মামলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত,” বেনারকে জানান তারেকের আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, এগুলো করে সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত
এদিকে উচ্চ আদালত কর্তৃক সাজা প্রাপ্ত হওয়ায় পরবর্তীতে সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তারেক রহমানের জন্য। দুর্নীতির মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ হলেন দলটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি তারেক রহামান। এই সাজা না হলে তারেক লন্ডন থেকে পলাতক অবস্থায়ই নির্বাচন করতে পারতেন।
নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের ১২ ধারায় প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা অংশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনেও একই কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে কেউ দুই বছর বা বেশি সাজা ভোগ করলে এবং সাজা ভোগের পর পাঁচ বছর পার না হলে সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
“আপিলের সুযোগ থাকলেও তারেক রহমানের এখন নির্বাচন করার সুযোগ নেই বললেই চলে,” বেনারকে জানান সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
রায় কার্যকরের দাবি
মানি লন্ডারিং মামলায় উচ্চ আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির নেতা তারেক রহমানকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল শুক্রবার তারা এ দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
সরকারি ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে। জুলাই ২২, ২০১৬। ফটোঃ ফোকাস বাংলা।
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এর আগে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যানটিনের সামনে থেকে মিছিল বের করেন।
“তারেক রহমান অর্থ পাচারকারী হিসেবে আদালতের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত। তাই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে বিচারের রায় কার্যকর করতে হবে,” বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান।
এই সাজা ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থী’
মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের সাত বছরের সাজাকে ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থী’ মনে করে বিএনপি। এর প্রতিবাদে শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ সব মহানগর, জেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
দলটির দাবি—হাইকোর্টে বিচার একতরফা হয়েছে। তারেকের পক্ষে কোনো আইনজীবী বক্তব্য রাখতে পারেননি। সময় এলে তারেক দেশে ফিরবেন এবং আপিল করবেন।
শুক্রবার সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের এই অবস্থান তুলে ধরেন দলের নেতা ও আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “আইনের বিধানমতে যে পর্যন্ত না তারেক রহমান দেশে আসেন এবং এখানে হাজির না হন, সে পর্যন্ত তাঁর পক্ষে আপিল করা সম্ভব নয়। ২০-৩০ বছর পরও ফৌজদারি মামলা করা যায়। ইনশা আল্লাহ যখন সময় আসবে, তারেক রহমান এই মাটিতে আসতে পারবেন। তখন আমরা আপিল করব এবং দেখাব এ মামলাটি সম্পূর্ণ বেআইনি হয়েছে।”
ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ
বিচারিক আদালতের বিচারক মো. মোতাহার হোসেনকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তিন কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গতকাল শুক্রবার মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি এ দাবি করেন।
শেখ সেলিম বলেন, রায় ঘোষণা করে সেই রাতেই বিচারক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কারণ, তিনি জানতেন নিম্ন আদালতে দেওয়া রায় ঠিক হয়নি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারক প্রভাবিত হয়ে তারেককে খালাস দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারেককে বেকসুর খালাস দেওয়ার দেড় মাস পর নিম্ন আদালতের বিচারক মোতাহার হোসেন অবসরে যান এবং এরপর তিনি সপরিবারে মালয়েশিয়া চলে যান।
এদিকে মামলার রায় দিয়েই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে ওই বিচারক মালয়েশিয়া থেকে টেলিফোনে ঢাকার এক সাংবাদিককে বলেন, “আমি ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারেক রহমানের মামলার রায় দিয়েছি। এরপর আরও প্রায় দেড় মাস ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৩-এর বিচারক হিসেবে ছিলাম।”
তিনি বলেন, “আমার জীবনের সর্বশেষ রায় ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর। এক ব্যবসায়ীকে আটকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ আদায় চেষ্টার অভিযোগে মোস্তফা কামাল নামে একজন পুলিশ সুপারকে আমি যাবজ্জীবন সাজা দিই। এই রায়ের পর থেকেই আমার জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। আমার ছেলেকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। প্রাণভয়ে আমি ও আমার ছেলে টুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় চলে আসি”।
উল্লেখ, ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক ও তাঁর বন্ধু ব্যবসায়ী মামুনকে আসামি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলাটি করে দুদক। টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন।
২০১১ সালের ৬ জুলাই এই মামলার বিচার শুরু হয়। রায় হয় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। রায়ে তারেক রহমানকে খালাস এবং গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।