ধর্ষণ নয়,যৌন সংসর্গের ইঙ্গিত তনুর ময়না তদন্তে;পরিবারের প্রত্যাখ্যান
2016.06.13
দু’দফা ময়নাতদন্তের পরেও কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা রহস্যের কিনারা মিলল না। প্রায় আড়াই মাস পর দেওয়া লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও মৃত্যুর আগে তনু ধর্ষণের বিষয়টি স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে মেডিকেল বোর্ড।
অথচ কিছুদিন আগেও মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি ডিএনএ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, হত্যার আগে অন্তত তিনজন তনুকে ধর্ষণ করেছে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের কথা উল্লেখ নেই। তবে মৃত্যুর আগে তনুর ‘যৌন সংসর্গ’ হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে।
সিআইডির তদন্তে ধর্ষণের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরেও প্রথম ময়না তদন্তের মতো দ্বিতীয় ময়না তদন্তে ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে ওই প্রতিবেদন দারুণভাবে সমালোচিত হচ্ছে। তনুর পরিবারের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগও এনেছেন তাঁর।
‘ধর্ষণ নয়, যৌন সংসর্গ’
তনু হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন হলেও গত তিন মাসে হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে শনাক্ত কিংবা আটক করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গতকাল রোববার দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছেন তনুর ময়না তদন্তে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান কামদা প্রসাদ সাহা। প্রতিবেদনটি সোমবার আদালতে জমা দিয়েছে সিআইডি।
এ বিষয়ে ডা. কামদা প্রসাদ সাহা সাংবাদিকদের বলেন, “মৃত্যুর আগে তনুর ‘এভিডেন্স অব সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স’ হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের জন্য মৃত্যুর ১০ দিন পর লাশ তোলা হয়েছে। ততদিনে মরদেহ বেশ পচা-গলে উঠেছিল। তাই নতুন করে কোনো আঘাত বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।”
ময়নাতদন্ত দলের অপর এক সদস্য ডা. ওমর ফারুক বলেন“সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স ও রেপ দুটো ভিন্ন জিনিস। সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্সও রেপ হতে পারে।”
পরিবারের প্রত্যাখ্যান |
রিপোর্ট‘মিথ্যা’ উল্লেখ করে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তনুর পরিবার। তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, “আমি এই প্রতিবেদন মানি না। মিথ্যা বলছেন ডাক্তার। তাদের কথা সত্যি হলে কেউ আমার মেয়েকে মারেনি। তাহলে বাড়ি থেকে যে সুস্থ মেয়েটি বের হয়েছিল, তাকে লাশ বানাল কে?”
ডাক্তাররা প্রভাবিত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার মেয়ে তনুর পিঠে, মাথার পেছনে নাকে আঘাতের দাগ ছিল। তা ছাড়া কবর থেকে তোলা তনুর লাশও তেমন ফোলা ছিল। তাহলে কেন তারা আঘাতের চিহ্ন পেল না।”
অস্পষ্ট ও হতাশাজনক
তনুর প্রথম ময়না তদন্তের মতোই দ্বিতীয় ময়না তদন্তও অস্পষ্ট থাকায় অত্যন্ত ‘হতাশাজনক’ বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী ও তনু হত্যার বিচারে সোচ্চার ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, প্রথম বারের ময়না তদন্তেরই প্রতিফল পাওয়া গেছে দ্বিতীয়বারের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনেও।
এতে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের দায়িত্ব অবহেলা কিংবা সত্য গোপনের চেষ্টা স্পষ্ট বলে মনে করেন তিনি।
সালমা আলী বলেন, “সরকারি কর্মচারী হিসেবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তার দায়-দায়িত্ব পালন করেননি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। কোনো কিছুকে চাপা দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে-এটা স্পষ্ট।”
আর মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “ডাক্তারের কথা অনুযায়ী যদি ধরে নেই তনুর ‘ইন্টার কোর্স’ হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে আসলে তিনি ধর্ষিত হয়েছিলেন। কারণ, সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি বলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর সে বিষয়টি ডাক্তার কেন লিখবে না, সেটাই আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।”
লাশ বিকৃত হওয়ার যুক্তি অস্বীকার করে এই আইনজীবী বলেন, “১০ দিনে লাশ এমন কোন বিকৃত হয় না। আমরা দেড় মাসের লাশ তোলার ঘটনাও আছে। তবু ধরে নিচ্ছি নি্র্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে ধর্ষণ বা জোরপূর্বক ইন্টার কোর্স হয়েছে কিনা সেটা ডাক্তাররা বলবেন। মৃত্যুর কতক্ষণ আগে এ ঘটনা ঘটেছে সেটাও স্পষ্ট করবেন তারা।”
তিনি বলেন, “ফরেনসিক এমন একটি বিভাগ, যে বিভাগ কতক্ষণ আগে, কত ঘণ্টা আগে, কীভাবে, মৃত্যু হয়েছে, তা উল্লেখ করে। তবে কুমিল্লার ফরেনসিক বিভাগ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানা করছে। এর ‘বেনিফিট অব ডাউট’ চলে যাবে আসামির পক্ষে।”
“সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স হয়েছে জানার পরেই আসামির আইনজীবীরা ঘটনার মোড়কে অন্যদিকে নিয়ে যাবেন। সীমা চৌধুরী বা ইয়াসমিনের ধর্ষণ ঘটনাগুলোতেও দেখেছি পুলিশ কিংবা ডাক্তারদের মধ্যে এক ধরনের ফাঁক রাখার মনোভাব। এটার বিহিত ব্যবস্থা হওয়া উচিত,” জানান সালমা আলী।
গত ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতর থেকে নির্মমভাবে নিহত হওয়া তনুর লাশ পাওয়া যায়। পরদিন লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত করা হয়। যে প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরে পুলিশের আবেদন করলে আদালতের আদেশে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। গত ৩০ মার্চ কবর থেকে তনুর লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়।
তবে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সময় তনুর শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনা ফরেনসিক ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা শেষে সিআইডি জানায়, তনুকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। ওই পরীক্ষা থেকে পৃথক তিন ব্যক্তির পাওয়া বীর্য থেকে ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা। ওই ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনও মেডিকেল বোর্ডকে দিয়েছিল তারা।