জঙ্গিবাদ দমনে কঠোর সরকার;পিস টিভি বন্ধ,জুম্মার নামাজের বয়ানে নজরদারি
2016.07.11
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পিস টিভি সম্প্রচারের অনুমতি বাতিল করেছে সরকার। গতকাল সোমবার তথ্য মন্ত্রণালয় এই টিভির ডাউন লিংকের অনুমতি বাতিল করে। এই টিভির উদ্যোক্তা ভারতের বিতর্কিত ইসলামি বক্তা জাকির নায়েক।
গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় হামলাকারীরা এই চ্যানেলটি দেখেই সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, এরকম খবর প্রকাশ হওয়ার পরেই ‘পিস টিভি’র সম্প্রচার বন্ধে দিল্লিকে অনুরোধ জানায় ঢাকা। গত শনিবার থেকে ভারতে চ্যানেলটি বন্ধ করা হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি দেশেও জাকির নায়েকের ‘পিস টিভি’ সম্প্রচার নিষিদ্ধ। উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য কানাডা ও যুক্তরাজ্য আগেই জাকির নায়েকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে।
গত রোববার ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
“পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পিস টিভিতে যেসব বক্তব্য প্রচার করা হয়, তাতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও উম্মাদনা সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই চ্যানেলটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বেনারকে জানান আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি আমির হোসেন আমু।
এদিকে পিস টিভির ডাউন লিংকের অনুমতি বাতিলের পর বাংলাদেশে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই টিভির সম্প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
শিগগিরই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আলেম-ওলামাদের অনেকে। তবে গ্রামে-গঞ্জে জাকির নায়েকের অসংখ্য ভক্ত রয়েছে।
“সরকার এটা বন্ধ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভ্রান্তিকর বক্তব্য কারও শোনা উচিত নয়,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।
তিনি বলেন, “জাকির একজন দাঁতের চিকিৎসক। ইসলাম নিয়ে ওনার বেশির ভাগ বক্তৃতাই কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী।”
ভারতেও সম্প্রচার বন্ধ
ভারতে ‘পিস টিভি’র সম্প্রচার করার অনুমতি নেই। তবুও স্থানীয় মুসলমান দর্শকদের চাপে বেআইনিভাবে অনেক কেবল অপারেটর এই চ্যানেলটি সম্প্রচার করেন বলে বিবিসরি এক খবরে বলা হয়।
জাকির নায়েক ভারতের মুম্বাই শহরের বাসিন্দা। আর তাঁর পরিচালিত যে ট্রাস্ট এই টিভি পরিচালনা করে, সেখানকার পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি পিস টিভির কার্যক্রম খতিয়ে দেখেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও জাকির নায়েকের বক্তব্যগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “জাকির এমন কিছু বলে থাকেন, যা ইসলামি শাস্ত্রমতে ঠিক নয়।এর ফলে যুব সমাজ উত্ত্যক্ত হচ্ছে আর আইন-শৃঙ্খলা, সংবিধানকে ডিঙিয়ে কিছু করার কথা ভাবছে, তাদের মগজ গরম হয়ে যাচ্ছে।”
বিবিসির খবরে আরও বলা হয়, কলকাতার স্থানীয় কেবল টিভি অপারেটরদের শনিবার থেকে ওই চ্যানেলের বেআইনি সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে বলা হয়।
বিশ্বখ্যাত দেওবান্দী ঘরানার ধর্মপ্রচারক ও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, “তিনি কোনো স্বীকৃত ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে পড়েননি। নিজেই পড়াশোনা করেছেন ইসলামের ব্যাপারে। তিনি অনেক কিছুই বলেন যা যুবসমাজকে উত্ত্যক্ত করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
তবে ভারতশাসিত কাশ্মীরের মুসলমান নেতারা মনে করছেন যে, জাকিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি।
হুরিয়ত কনফারেন্সের নেতা সাঈদ আলি শাহ গিলানী বিবিসিকে বলছেন, জাকির ইসলামের মূলমন্ত্র প্রচার করছে। কিন্তু আরএসএস ষড়যন্ত্র করছে এটা বন্ধ করার।
জুমার নামাজের বয়ান নজরদারি
এখন থেকে জুমার নামাজের বয়ানে নজরদারি এবং ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করবে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের ১২টি দপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়।
“প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের বয়ান নজরদারি করা হবে। আর যাঁরা খুতবা পড়াবেন, তাঁরা যেন প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, সে বিষয়টিও দেখা হবে। ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে,” বেনারকে জানান কমিটির সভাপতি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হিসাবে দেশে মসজিদ আছে প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ মসজিদে জুমার নামাজ হয়।
এই বিপুল সংখ্যক মসজিদে নজরদারি করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে আমির হোসেন বিবিসিকে জানান, “যারা নামাজ পড়ে তাঁরাই তো জানতে পারবে, বুঝতে পারবে। আমাদের পার্টিরও বহু লোক জুমার নামাজ আদায় করেন। আমি নিজেও পড়ি।”
তিনি আরও বলেন, অভিযোগ জানাবার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে ও টেলিফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরদারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় সরকারকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে বলা হয়, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে।
গত ১লা জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের মাঠের কাছে হামলা হয়। হামলাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, স্কলাস্টিকা স্কুলসহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। তাঁদের অনেকেই কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন।
“শিক্ষার্থীদের নিয়মিত লেখাপড়া নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ ও চলাফেরার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে,” বেনারকে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারও গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে।