দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে জিকা ভাইরাস রোধে বিশেষ সতর্কতা
2016.09.01
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে আকস্মিকভাবে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণকারী ও বিদেশ থেকে দেশে ফেরা যাত্রীদের মনিটরিং এর জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গুলোতে বিশেষ প্রযুক্তির স্ক্যানিং চেক পোস্ট বসানো হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়োটারসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১৫ তে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ,ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের নাগরিকেরাও আছেন যারা সিঙ্গাপুরে ওই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত।
বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া জিকা আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্তকরনে বিমানবন্দর গুলোতে থার্মাল স্ক্যানার স্থাপন করেছে এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় মিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনে রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) কারিগরি উপদেষ্টা ডাঃ এম মুশ্তাক হুসাইন বেনার নিউজকে বলেন, “আমরা প্রতিটি বিমান, স্থল ও নৌ বন্দর গুলোতে জ্বর আক্রান্ত ব্যক্তি নির্ণয়ে থার্মাল ডিকেক্টর স্থাপন করেছি- যা কিনা জিকা ভাইরাসের প্রাথমিক লক্ষন।”
তিনি জানান, “আমারা বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করে থাকি তাঁদের মধ্যে কেউ জিকা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কিনা”।
জিকা কিভাবে ছড়ায়
চিকিৎসাবিদরা বলছেন, মূলতঃ এডিস প্রজাতির মশা থেকে মানুষের দেহে জিকা ভাইরাস ছড়ায়। যে কোনো মশা একজন সংক্রামিত ব্যক্তিকে কামড়ে যদি কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায় তবে ওই ব্যক্তিও জিকা আক্রান্ত হতে পারেন। সংক্রামিত ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও সঙ্গীর দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। কোন গর্ভবতি মহিলা যদি এই ভাইরাস আক্রান্ত হন তবে গর্ভের শিশুটিও ভাইরাস আক্রান্ত হয় এবং জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম গ্রহন করে।
জ্বর, হাড়ের জোড়ায় ব্যথাসহ নানা ধরনের ছোটছোট শারীরিক অসুস্থতা এই ভাইরাসের উপসর্গ। তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তা সেরে ওঠে।
উল্লেখ্য, ব্রাজিল ২০১৬-র গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের স্বাগতিক দেশ, যা বিশ্বের সর্বাধিক জিকা কবলিত অঞ্চল। চলতি বছর আগস্টে ব্রাজিলের রিওতে বসে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আসর। অলিম্পিক উপলক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকরা এ সময় ব্রাজিল সফর করেন। যাদের কেউ কেউ ওই সময় জিকা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারনা করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরে কর্মরত শ্রমিকদের ব্যপারে সতর্ক বাংলাদেশ
বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব-উজ-জামান সেখানে ছয় জন বাংলাদেশি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।জিকা আক্রান্ত বাংলাদেশিরা বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন এবং সেরে উঠছেন বলে জানান তিনি।
গত মে মাসে সিঙ্গাপুরে প্রথমবারের মতো জিকা আক্রান্ত এক ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এর কিছুদিন আগে ওই ব্যক্তি বিশ্বের জিকা ভাইরাস কবলিত অঞ্চল ব্রাজিল সফর করেন বলে জানা যায়। এবার সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে ৪১ জন জিকা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। যাদের ৩৬জন বিদেশি নির্মাণ শ্রমিক বলে জানানো হয়। এরা সিঙ্গাপুরেই জিকা আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের হাই কমিশনার মাহবুব-উজ-জামান বেনারকে বলেন, “বুধবার (৩১ আগস্ট) সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জিকা আক্রান্তদের মধ্যে বাংলাদেশি থাকার কথা আমাদেরকে জানায়। তিনি বলেন, “আমরা ধারণা করছি এসব বাংলাদেশিরা এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা তাঁদের মনোবল বাড়াতে দেখা করার অনুমতি চেয়েছি। পুরোপুরি সেরে ওঠা পর্যন্ত তাঁদের পাশে থাকব আমরা।”
বাংলাদেশ হাইকমিশনার বলেন, “বাংলাদেশি শ্রমিক এবং কমিউনিটিতেও আমরা জিকা ভাইরাস সম্পর্কে অবহিত করে তাঁদের সতর্ক করছি। অন্য তৎপরতাও বাড়িয়ে দিয়েছি। জিকা বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
এদিকে জিকা নিয়ে ভয় না পাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও। এ প্রসঙ্গে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “জিকা ভাইরাস অনেকটা ডেঙ্গু ও চিকুন গুনিয়া জ্বরের মতোই। এতে সাধারণত রক্তক্ষরণ হয় না। তবে জিকা ভাইরাস গর্ভবতী নারীদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ, কোন গর্ভবতী নারী জিকা আক্রান্ত হলে তার গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসিব শিশুর যথাযথ মস্তিষ্ক বৃদ্ধি না হওয়ায় তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নেয়”।
মালয়েশিয়ায় সতর্কাবস্থা
বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রী এস সুব্রামানিয়াম এক বিবৃতিতে বলেন, মালয়েশিয়ার সব রাজ্যে মশা পর্যবেক্ষণ এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম তীব্রতর করা হয়েছে, বিশেষত জোহর এবং সেলাঙ্গোর রাজ্যে।
মন্ত্রী বলেন, সিঙ্গাপুর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরে পাঁচজন মালয়েশিয়ান সংক্রমিত হয়েছেন, যারা সিঙ্গাপুরে বসবাস ও কাজ করেন।
সুব্রামানিয়াম বলেন, ৫৮ বছর বয়েসী একজন মহিলা জিকা ভাইরাস পজেটিভ সনাক্ত হয়েছেন,যিনি মধ্য আগস্টে সিঙ্গাপুরে তিন দিনের সফরে তাঁর মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন।তাঁর মেয়ে আগে থেকেই ওই ভাইরাস আক্রান্ত ছিল। গত বুধবার গায়ে জ্বর ও ফুসকুড়ি নিয়ে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
ইন্দোনেশিয়ায় একজন নিশ্চিত ভাবে সনাক্ত
ইন্দোনেশিয়াও দেশের আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে থার্মাল স্ক্যানের স্থাপন করেছে এবং ভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে কিছু নির্দেশমালা জারি করেছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরমানাথা নাসির নিশ্চিত করেছেন সিঙ্গাপুরে জিকা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে একজন ইন্দোনেশিয়ান নারী আছেন, যিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুর থেকে আসা পর্যটক ও যেসব ইন্দোনেশিয়ানরা সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন তাঁদের প্রত্যেককে হেলথ কার্ড ও এই ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারপত্র দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান প্রায় দুই লক্ষ ইন্দোনেশিয়ান সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন এবং ২ লক্ষ ৭৩ হাজার ইন্দোনেশীয়ন গত বছর সিঙ্গাপুর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
থাইল্যান্ডে জরুরী অবস্থা জারি
থাইল্যান্ড তার সীমানার মধ্যেই একটি আশঙ্কাজনক জিকা আক্রান্ত সংখ্যা দেখতে পাচ্ছে। দি ইওরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইসিডিসি) দেশটিতে গত তিন মাসে ব্যাপক সংক্রমণের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
চলতি ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসেই দেশটিতে ৯৭ জন জিকা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যাক্তি সনাক্ত হয়েছেন।তবে ওই আক্রান্ত ব্যাক্তিদের সকলেই এখন সেরে উঠেছেন বলে বেনার নিউজকে জানান থাইল্যান্ডের রোগ নিয়ন্ত্রন বিভাগের মহাপরিচালক ডাঃ আমনুয়াই গাজিনা।
তিনি আরও জানান, “এই মুহূর্তে থাইল্যান্ডের চারটি অঙ্গরাজ্যে ১৩ জন জিকা আক্রান্ত রোগি আছেন”।
জাকার্তা থেকে তিয়া আসমারা, ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরি,কুয়ালালামপুর থেকে হাইরীজ আযীম আযিযি এবং ব্যাংকক থেকে নন্তারাত ফাইচারোন প্রতিবেদনটি লিখতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।