চলে গেলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ
2019.12.20
ঢাকা
চলে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা—ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। শুক্রবার রাতে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন, ব্র্যাকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
নিজ কর্মগুণে বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন আবেদ, বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। মাস কয়েক আগে তিনি ব্র্যাকে তাঁর উত্তরাধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম ঠিক করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বেনারকে বলেন, “অসাধারণ গুণের অধিকারী ছিলেন আবেদ ভাই। অসুস্থ হওয়ার পর নিজের উত্তরাধিকার ঠিক করাসহ ব্র্যাক কীভাবে চলবে তার রূপরেখা ঠিক করে গেছেন। বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষা–স্বাস্থ্যের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
ব্র্যাক জানিয়েছে, “তিনি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”
ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর সংবাদে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, “ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, “১৯৭১ সালে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ড থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠন করেন। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও তিনি কাজ করেন।”
তিনি আরও বলেন, “তাঁর মতো মানবতাবাদী মানুষের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”
১৯৭২ সালে ফজলে হাসান আবেদের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ব্র্যাক বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করে।
শুক্রবার রাত ১১টায় ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্র্যাক পরিবারের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘শ্রদ্ধেয় আবেদ ভাই’। তাঁর কাছে মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়নই ছিল তাঁর অগ্রাধিকার। সততা, বিনয় ও মানবিকতারের বিরল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর এসব গুণ ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে,” বলেন আসিফ।
আসিফ সালেহ জানিয়েছেন, রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে।
সেখানে জানাজার পর তাঁকে রাজধানীর বনানী করবস্থানে দাফন করা হবে।
এক নজরে স্যার আবেদ
ব্র্যাকের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লন্ডনে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়ালেখা করেন। ১৯৬২ সালে কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে উত্তীর্ণ হন।
পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানিতে সিনিয়র কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ এবং ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭২ সালে ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
৬৫ বছর বয়সে নির্বাহী পরিচালকের পদ ছেড়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তিনি। তবে চলতি বছরের আগস্ট মাসে ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে এমিরেটাস হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
দারিদ্র বিমোচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফজলে হাসান আবেদ জীবনে অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ২০১১ সালে ওয়াইজ প্রাইজ অব এডুকেশন, ২০১৪ সালে লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল ম্যারিট, ২০১৫ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পুরস্কার অর্জন করেন ফজলে হাসান আবেদ।
চলতি বছর সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরা অ্যাওয়ার্ড, শিক্ষায় ভূমিকা রাখায় ইয়াডান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তিনি।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অশোকা স্যার ফজলেকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের নির্বাচিত ৫০ বিশ্বনেতার মধ্যে স্থান পেয়েছিল ফজলে হাসান আবেদের নাম।
যেভাবে ব্র্যাকের শুরু
মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কর্মসূচি শুরু করেন ফজলে হাসান আবেদ। পরে ত্রাণ দিয়ে সহায়তার বদলে দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করে তোলার কাজ শুরু করেন তিনি। সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাক।
পরে ১৯৭৩ সালে উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করলে ব্র্যাকের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ রাখা হয়।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি সংস্থায় পরিণত হওয়া ব্র্যাক ক্ষুদ্র ঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বাল্যবিবাহ রোধসহসহ নানা খাতে কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃত। ব্র্যাকের প্রধান লক্ষ্য দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ক্ষমতায়ন।
২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টানা চার বছর জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা ‘এনজিও অ্যাডভাইজার’ কর্তৃক ব্র্যাক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রভাব, উদ্ভাবনশীলতা, টেকসই সমাধান এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিশ্বের ৫০০ এনজিওর মধ্যে তুলনার ভিত্তিতে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন আমিরা হক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সততা, বিনয় এবং মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর এ সকল গুণাবলীই ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে।”