সড়কে নৈরাজ্য বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা
2018.04.27
ঢাকা
দেশের রাস্তায় বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন চলছে, যার ৭২ শতাংশেরই ‘ফিটনেস’ নেই। এ ছাড়া মোট ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ১৬ লাখের বেশি নয়।
এমন তথ্য প্রকাশের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “মাঠপর্যায়ে আমরা যে জরিপ করেছি, তারই অংশবিশেষ এটি, যা ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।”
তাঁর দাবি, “অধিকাংশ স্থলযান আইন না মেনে বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।”
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক দুর্ঘটনা বিরোধী এক মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, গণপরিবহন খাতকে সকল প্রকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি নামে একটি বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত ওই কর্মসূচিতে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক নেতা ও আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সরকারি হিসেবে, এখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা গড়ে প্রায় ৬৪ জন।
এই প্রেক্ষাপটে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ উদঘাটন করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কাজ শুরু করেছে। সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বেনারকে বলেন, “যে চালক-শ্রমিকেরা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।”
তিনি জানান, দুর্ঘটনা কমাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) দুর্ঘটনার কারণ-সংক্রান্ত পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে থাকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির জন্য এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাবে আরো ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে।
জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভাপতি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকে বলেন, “চালকদের আরও সচেতন হতে হবে।”
এদিকে ঢাকার ৮৭ শতাংশ গণপরিবহন বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলে সম্প্রতি তথ্য প্রকাশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তবে পরিবহন মালিক নেতা এনায়েত বলেন, “পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটায় এভাবে বলা হচ্ছে; কিন্তু বিষয়টি সত্য নয়।”
তাঁর মতে, “ঢাকায় অদক্ষ ড্রাইভার বেশি। ট্রিপ ভিত্তিক চুক্তিতে চলা বাসের সংখ্যাও কম নয়। যে কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।”
প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের মৃত্যু
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরও দেড়শতাধিক।
“স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে তৈরি হেল্থ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬ থেকে আমরা এই তথ্য পেয়েছি,” জানান মোজাম্মেল।
সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, “সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন বহু মানুষ প্রাণ হারালেও সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না।”
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তৈরি করা হিসাব অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৭৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে এক হাজার ৮৪১ মানুষ।
একইভাবে তৈরি নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির হিসাবে, গত বছরের ৩০ এপ্রিল অবধি দেশে এক হাজার ৩৭২ দুর্ঘটনায় কমপক্ষে এক হাজার ৫৫২ জন মারা গিয়েছিল।
বেসরকারি হিসাবে, ২০১৭ সালে দেশে চার হাজার ৯৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় মোট সাত হাজার ৩৯৭ জন এবং ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২ দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত হয়।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গত রোববার বলেন, “যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখিত।”
মালিক-শ্রমিকদের চাপে সরকার
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যার সাজা কঠোর করার দাবি তোলা নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নেমেছিল নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙার নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও সমর্থন দিয়েছিল তাঁদের।
আশির দশকে শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখেই সড়কে মৃত্যুর সাজা ১৪ বছর থেকে তিন দফায় কমিয়ে তিন বছর করা হয়।
মোজাম্মেল মনে করেন, দুই জন প্রতিনিধি মন্ত্রী হওয়ায় এখন শুধু মালিক-শ্রমিকেরাই সরকারের ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করতে পারে।”
দুর্ঘটনা কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কোনো চেষ্টা নেই জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ মহাসচিব বলেন, “সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী এই ফোরামেও জনস্বার্থে কোনো আলোচনা হয় না।”
ছয় মন্ত্রী, ১১ সচিবসহ পুলিশ ও পরিবহন খাতের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এ কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বেনারকে বলেন, “যারা কাউন্সিলের মূল কর্তা, তাঁরাই এর হর্তা-কর্তা-বিধাতা। আমি সিভিল সোসাইটির সামান্য প্রতিনিধি মাত্র।”
“অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু সুযোগ কই? গত ছয়-সাত মাসে কাউন্সিলের কোনো বৈঠক হয়নি,” জানান এই লেখক ও গবেষক।
জুনেই আসছে নতুন আইন
দেশের পরিবহন খাত চলছে ভারতীয় মোটরযান আইন-১৯৩৯ এর পরিমার্জিত রূপ ‘মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩’ অনুযায়ী।
আইনমন্ত্রী জানান, দুর্ঘটনার হার কমাতে আগামী জুনের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত ‘সড়ক পরিবহন আইন’ সংসদে উত্থাপন করা হবে।
তবে মোজাম্মেল বলেন, “এই আইন সড়কে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা আরও বাড়াবে। কারণ সরকার এটি নিয়ে মূল অংশীজন তথা যাত্রীদের সাথে কোনো আলোচনা করেনি।”
আইন মন্ত্রীর বক্তব্য, “এটি নিয়ে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি।”
মোজাম্মেল বলেন, “নতুন আইনে যেসব কমিটির কথা বলা আছে, সেখানেও শুধু মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি থাকবে।”
তবে আইনমন্ত্রীর দাবি, “এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি আইনে সড়ক পরিবহনের ‘এ টু জেড’ সব কিছু দেখার।”
বাস মালিক নেতা এনায়েত বলেন, “নতুন আইনে শাস্তি ও জরিমানা অনেক বেশি রাখা হয়েছে। এটির প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা অবশ্যই কমবে।”
ওই নেতার মতে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে আইন করলে হবে না, সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিও খুব দরকার। যাত্রী-পথচারীকেও সচেতন করতে হবে।