পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ
2021.04.29
ঢাকা
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাকে ‘নীরব মহামারি’ উল্লেখ করে জাতিসংঘ প্রতি বছর ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব ডুবে-মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ একটি রেজুলেশন গ্রহণ করেছে বুধবার, প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ, সহযোগী ছিল আয়ারল্যান্ড।
“জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের রেজুলেশন এটাই প্রথম, উল্লেখ করে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন থেকে বৃহস্পতিবার পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ২০১৮ সালে থেকে কাজ করে আসছিল।”
পানিতে ডুবে মৃত্যু বিশ্বের প্রতিটি জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে উল্লেখ করে রেজুলেশনটিতে অগ্রহণযোগ্য উচ্চহারের এই মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনাও প্রদান করা হয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা ওই রেজুলেশনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, সেই হিসেবে দিনে গড়ে প্রায় ৪০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
অন্য দিকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে দুই লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায় বলে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবনায়।
জাতিসংঘের এই পদক্ষেপ “পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যু প্রতিরোধে বিশাল ভূমিকা রাখবে,” বলে মনে করেন বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) উপ-নির্বাহী পরিচালক আমিনুর রহমান।
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজারের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ১০ হাজারের বয়স পাঁচ বছরের নিচে বলে জানান তিনি।
“যেহেতু শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় জলাশয় অর্থাৎ নদী, পুকুর এবং খাল বেশি, সেহেতু পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা শহরের তুলনায় গ্রামে চার গুনেরও বেশি,” বলেন আমিনুর।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সচেতনতাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই গবেষক।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর বৈশ্বিক রিপোর্ট ২০১৪ বলছে, বাংলাদেশে এক থেকে চার বছরের যত শিশু মারা যায়, তার ৪৩ শতাংশরই মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে।
জাতিসংঘের ওই রেজুলেশনে আরও বলা হয়, পানিতে ডুবে-মৃত্যুর মতো প্রতিরোধযোগ্য কারণেও বিভিন্ন দেশে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা অকালে প্রাণ হারাচ্ছে।
এতে বলা হয়, “পানিতে ডুবে-মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জাতীয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা এবং এ বিষয়ক সর্বোত্তম অনুশীলন ও সমাধানসমূহ পারস্পরিকভাবে ভাগ করে নেওয়ার লক্ষ্যে ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব ডুবে-মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ পরিষদ।”
রেজুলেশনটি উত্থাপনের সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, “পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বৃহত্তর বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্যে একটি জাতিসংঘ রেজুলেশন গ্রহণের তাগিদ অনুভব করেছিল বাংলাদেশ।”
“আমরা বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারকে শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে না আনা যায় তাহলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের সাফল্য অর্জন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৯০ ভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে, যার মধ্যে এশিয়াতে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি জানিয়ে রাবাব ফাতিমা বলেন, “পানিতে ডুবে মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি বৈষম্য।”
তিনি বলেন, যেহেতু পানিতে ডুবে-মৃত্যুর ঘটনাগুলো দরিদ্র পরিবারকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাই এটি প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা?
পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত ফাতিমা বলেন, ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাক্সফোর্স ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু হ্রাস সংক্রান্ত জাতীয় কৌশল’ প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বেনারকে বলেন, নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পানিতে ডুবে মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য একটি বড়ো সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
তিনি বলেন, “নদীপথে চলাচলের সময় যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে জাহাজ, লঞ্চ এবং নৌকাসহ অন্যান্য বাহনে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট রাখা এবং নদী পথের চলাচলকে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।”
অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করার পাশাপাশি এ বিষয়ে আরো যেসব উদ্যোগ নেয়া যায়, তা নিয়েও কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টার, শিশু বেষ্টনী তৈরি এবং সাঁতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন সিআইপিআরবি’র আমিনুর রহমান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী ও জলাশয় থাকা এলাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এমন একটি অঞ্চল হচ্ছে বরিশাল বিভাগ, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৯টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বলে জানায় বেসরকারি সংস্থা সমষ্টি।
তাদের হিসেবে গত বছর (২০২০) বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ৪২৫টি ঘটনায় ৭৭৯ জন পানিতে ডুবে মারা যায়, যার ৮২ শতাংশই শিশু। যদিও সংস্থাটি বলেছে, অনেক মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না।
ওই জরিপ অনুযায়ী, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন, বাবারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান। তাছাড়া গ্রামে সন্ধ্যার দিকে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অনিচ্ছাকৃত আঘাতজনিত মৃত্যুর অন্যতম সর্বোচ্চ কারণ হিসেবে গণ্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।