ছাত্র আন্দোলনের চতুর্থ দিনে অচল ঢাকা, চাপে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী ও শরীফ খিয়াম
2018.08.01
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
180801_student_movement_1000.jpeg বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদের চতুর্থ দিনে ঢাকার শাহবাগে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ। ১ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনের চতুর্থ দিনে সরকারের আশ্বাস এবং আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা। পরিস্থিতি সামলাতে রাজধানীসহ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহস্পতিবার বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

সড়ক নিরাপদ করতে সরকার বাস্তবমুখী ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত তারা ফিরবে না। ঢাকার সিটি কলেজের মিল্টন নামের এক শিক্ষার্থী বেনারকে বলেন, “আজকের (বুধবার) মতো আমাদের কর্মসূচি শেষ। দাবি জানাতে আগামীকাল আবার আমরা একত্রিত হব।”

এয়ারপোর্ট রোডে বিক্ষোভরত শাকিল নামের আরেক শিক্ষার্থী বেনারকে বলেন, “আমরা কোনো প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না। আমাদের সহপাঠীদের হত্যাকারী চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং সবার জন্য নিরাপদ সড়ক চাই।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বুধবার রাতে জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে’ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে মহানগরীর প্রধান চৌরাস্তাগুলো অবরোধ করে পুরো রাজধানী অচল করে দেয়। এরই প্রেক্ষিতে সরকারের প্রভাবশালী তিন মন্ত্রী তাঁদের ‘বিক্ষোভ’ এবং ‘সব দাবি’ যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন।

ঢাকায় অবৈধভাবে কোনো গণপরিবহন চলতে দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা করে সরকার। এ ছাড়া সড়কে চালকদের নৈরাজ্য কমাতে প্রস্তাবিত নতুন আইনটি আগামী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে যাত্রী অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে এখন অনেক ধরনের কথা বলা হচ্ছে।”

বেনারকে তিনি বলেন, “সরকার আশ্বাস দিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘরে ফেরাতে চাইছে, যার পরিণতি আরও খারাপ হবে। কারণ পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য আজ যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা যে কোনো মুহূর্তে এক গণবিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।”

এর আগে দুপুরে সচিবালয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্টদের সাথে এক জরুরি বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “তারা (আন্দোলনকারীরা) বিভিন্নভাবে আমাদের (সরকারের) কাছে যেসব দাবি পৌঁছেছে, সেগুলো সবই যৌক্তিক। পর্যায়ক্রমে সবগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

অন্যদিকে সকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেন, “এই বিক্ষোভ অযৌক্তিক মনে করি না, এর যৌক্তিকতা রয়েছে। সরকার বিষয়টি নিয়ে সচেতন ও মর্মাহত।”

“সড়কে যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই,” যোগ করেন জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এই সভাপতি।

এদিকে নগরজুড়ে গণপরিবহনের সংকটে বুধবার সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত রাজধানী কার্যত অচল ছিল। শিক্ষার্থীদের ভাঙচুর ও বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে পরিবহন মালিকরাও গাড়ি বন্ধ রাখায় এই অবস্থার তৈরি হয়।

যদিও শ্রমিক নেতা ওসমান আলী বেনারকে বলেন, “মূলত নিরাপত্তার অভাবে অনেকে গাড়ি বের করেননি।” সড়কমন্ত্রী কাদেরও সাংবাদিকদের জানান, মালিকেরা রাস্তায় বাস নামাতে ভয় পাচ্ছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’—স্লোগান তুলে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আগের দিন পুলিশের লাঠি চার্জের ঘটনায় অনেক ক্ষুব্ধ তরুণ-যুবকও বুধবার রাস্তায় নামে।

কোথাও লাঠি চার্জের ঘটনা না ঘটলেও এই দিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকেরা শিক্ষার্থীদের মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া শনির আখড়ায় ধাওয়ার মুখে এক আন্দোলনকারীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে একটি ট্রাক।

একই দিনে যানবাহন ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও নিরাপত্তার দাবিতে নারায়ণগঞ্জে এবং রাজধানীর শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, চিটাগং রোড, মাতুয়াইলে সড়কে পাল্টা অবরোধ করেছে পরিবহন শ্রমিকরা।

অভিভাবক-শিক্ষকদের উদ্যোগ আহবান

গত রবিবার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই কলেজ শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে নিতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“ইতিমধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেছ। ফিটনেস, লাইসেন্স বা রুট-পারমিটবিহীন কোনো গাড়ি আমরা আমাদের শহরে চলতে দেবো না। টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ার আগেই সবকিছু চেক করা হবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি জানান, ভবিষ্যতে রাস্তায় এ জাতীয় গাড়ি পাওয়া গেলে মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও এ ব্যাপারে সহযোগিতার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা। তাঁর সাথে ছিলেন সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

এ ছাড়া পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে ছিলেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের আজকের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।” তাঁর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বেনারকে বলেন, “আগামী ৩ আগস্ট থেকে টার্মিনালগুলোতে ‘চেকিং’ শুরু হবে।”

উল্লেখ্য, বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনার পরদিন গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় হাস্যোজ্জ্বল থাকার কারণে নৌমন্ত্রীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত আন্দোলনকারীরা। তাদের নয় দফার মধ্যে এই মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও অন্যতম।

শাহবাগ মোড়ে বুধবার তার কুশপুত্তলিকাও দাহ করা হয়েছে।

অন্যদিকে রবিবারে বাসচাপায় জড়িত জাবালে নূর পরিবহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ ছাড়া দুই বাস চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ ছাড়া সন্ধ্যায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) থেকে পাঠানো এক খুদেবার্তায় জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের পিষ্টকারী বাসের মালিক শাহাদত হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আন্দোলনের সুযোগে অরাজকতার চেষ্টা

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগ, একটি মহল এই আন্দোলনের সুযোগে অরাজকতা তৈরি করছে চাইছে। তিন দিনে তারা ৩০৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এর মধ্যে ২৯ তারিখে ১৫০ টি গাড়ি ভাঙা হয়েছে, ৩০ তারিখে ২৫ টি গাড়ি, ৩১ তারিখে ১৩৪টি গাড়ি ভাঙা হয়েছে।

গাড়ি পোড়ানো হয়েছে আটটি, এর মধ্যে পুলিশের এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্বার্থান্বেষী মহল এই ভাঙচুর এবং গাড়ি পোড়ানোর কাজ গুলো করছে।” বুধবারও একাধিক পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস ভাঙচুর এবং শেওড়াতে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

সড়কের বিশৃঙ্খলা ঠেকাবে নতুন আইন

ওবায়দুল কাদেরের মতে, “প্রস্তাবিত সড়ক নিরাপত্তা আইন পাস হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।” আগামী সপ্তাহে এটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে জানিয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যে আইনটি সংসদে পাস হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

এই আইন সংক্রান্ত ফাইলে সই শেষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী চান আইনটি দ্রুত পাস হোক এবং অপরাধীরা শাস্তি পাক।”

“আইনটিতে তড়িৎ গতিতে বিচারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই আইনে সংশ্লিষ্ট কোনো অপরাধী আইনের কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হতে পারবে না,” যোগ করেন মন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।