নিরাপদ সড়কের আন্দোলন: সরকার কঠোর

শরীফ খিয়াম
2018.08.10
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
180810_BD_protest_1000.JPG নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের মিছিল। ৫ আগস্ট ২০১৮।
রয়টার্স

পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের সক্রিয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন মানবাধিকার কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তাঁরা আন্দোলনে জড়িতদের ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানালেও সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে।

এদিকে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শুক্রবার রাত দশটার দিকে রাজধানীর মিরপুর রোডের কলেজ গেট এলাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিয়েছে একটি বাস।

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে শের-ই-বাংলানগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন বেনারকে বলেন, “মন্ত্রী মহোদয় আহত হয়েছেন কি’না তা আমার জানা নেই। তবে বাস এবং হেলপার মানিককে (২৩) আটক করা হয়েছে।”

তিনি আরো জানান, মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী নিউভিশন পরিবহনের ওই বাসটি চালক নয়, হেলপারই চালাচ্ছিল।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে লাইসেন্সবিহীন চালক ও সহকারীদের গাড়ি চালনা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা শত শত লাইসেন্সবিহীন চালককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

সরকার কঠোর

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “ছাত্র আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন আটক হয়েছে। বাকি যারা জড়িত আছে, ইন্ধনদাতা আছে, তাদেরও শিগগির আটক করা হবে।” চাঁদপুর পুলিশ লাইনসে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল শুক্রবার রাতে বেনারকে বলেন, “তারা (সরকার) আইনের বাইরে গেলেই আমাদের (মানবাধিকার কর্মীদের) প্রশ্ন থাকে।”

“অপরাধ ঘটে থাকলে অপরাধ ও অপরাধী চিহ্নিত হোক এবং আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক; এ নিয়ে মন্তব্য থাকবে না। কিন্তু সবক্ষেত্রে তা হচ্ছে না বলেই আমাদের উদ্বেগ,” বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।

এর আগে বুধবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে দেখা করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা ও রিমান্ড প্রত্যাহার এবং তাঁদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার অনুরোধ জানান।

জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “ক্ষমা করার মালিক আমরা (মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়) নই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে কেউ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে তাঁরা খেয়াল রাখবেন।

এদিকে সরকারের মনোভাব হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষমা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষমা করা হবে না। বৃহস্পতিবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে তাঁরা অংশ নেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নয়দিনের আন্দোলনে রাজধানীর ১৬টি থানায় ৩৫টি মামলা হয়েছে, এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে অন্তত ৪২ জন।

এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ছয়টি মামলায় নয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে আছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং অভিনয়শিল্পী নওশাবা আহমেদ।

ফেসবুক লাইভে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অভিনেত্রী-মডেল কাজী নওশাবা আহমেদকে আরও দুই দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। প্রথম দফায় চার দিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার তাঁকে আদালতে হাজির করে আরও ১০ দিন রিমান্ড চাইলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে কাজী নওশাবার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।

আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশ রিমান্ডে আছেন শহিদুল আলম। তাঁর মুক্তি দাবিতে হাইকোর্টে তাঁর স্ত্রীর দায়ের করা রিট আবেদন বৃহস্পতিবার খারিজ হয়ে গেছে​।

এদিকে শহিদুল আলমকে ‘বেআইনিভাবে গ্রেপ্তারের’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও অধিকারকর্মী নোয়াম চমস্কি, অরুন্ধতী রায়সহ একদল বুদ্ধিজীবী।

শুক্রবার এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, “তথ্য উপস্থাপন ও সমালোচনা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো রাষ্ট্র যদি তার নাগরিককে যা ঘটছে তা বলতে না দেয় এবং এজন্য কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন।”

আন্দোলনে সুফল, আন্দোলনকারীরা আতঙ্কে

নিরাপদ সড়কের দাবিতে নয়দিনের ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস না থাকা গাড়ি রাস্তায় কম নামছে। তবে বেপরোয়া ও বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানো সেই অর্থে কমেনি।

ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা করে পুলিশ। এর ষষ্ঠ দিনে শুক্রবার পর্যন্ত পুলিশ সারাদেশে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪২৩টি যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। জরিমানা আদায় করেছে​ ৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৩ টাকা। এ সময় ৪০ হাজার ৬৩০ জন চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আটক করা হয় ৩ হাজার ৫৪৪টি যানবাহন। শনিবার ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হবে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “যারা ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করেছিল, তাদের আইনের আওতায় না এনে বরং যৌক্তিক আন্দোলন করা সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করাটা দুঃখজনক। এ ঘটনা সমাজে এক ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সাধারণ ছাত্রদের এই আন্দোলনে বিরোধী দলের রাজনীতি বিশেষ করে বিএনপি–জামায়াত যুক্ত হয়। তারাই আন্দোলন নস্যাত করেছে, শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।”

ইকবাল সোবহান আরও বলেন, পুলিশ স্কুল–কলেজের কোনও শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সমাজের বিভিন্ন স্তরের যেসব মানুষ এই আন্দোলনে উসকানি দিয়েছে, গুজব ছড়িয়েছে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এর বিকল্প নেই বলেও মত দেন তিনি।

রাজনৈতিক বিতর্ক

ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক, একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ শুক্রবার বলেছেন, “কখন, কোথায় কী ঘটনা ঘটবে, কেউ জানে না। দেশে কোনো সরকার নেই। যেটুকু আছে সেটুকুরও পরিবর্তনের সময় চলে এসেছে। কারণ এই সরকারের শেষ সময় এসে গেছে।”

জাতীয় প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় মওদুদ আহমদ এ মন্তব্য করেন। ‘শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক নির্যাতন এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা কেন?’ শিরোনামে এই সভার আয়োজন করে নাগরিক অধিকার আন্দোলন ফোরাম নামের একটি সংগঠন।

এর জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বলেছেন, মওদুদ সাহেবের কথায় এ দেশের মানুষ বা তরুণেরা বিভ্রান্ত হবে না। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে এ কথা বলেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি নয় বছরে নয়টা মিনিট রাস্তায় দাঁড়াতে পারেনি। তারা কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করে ব্যর্থ হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের ওপর ভর করে ব্যর্থ হয়েছে, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের ওপর ভর করেও সফলতার মুখ দেখেনি। এখন তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।