তনুর পরিবারকে ঢাকায় ডেকে সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদ

প্রাপ্তি রহমান
2017.11.22
ঢাকা
171122-BD-investigation-620.jpg তনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল। এপ্রিল ০৩, ২০১৬ ।
Photo: Benar

কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। অবশেষে হত্যাকাণ্ডের দেড় বছর পর পুলিশি তদন্তে কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা সেনানিবাসে তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল বুধবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তনুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে।গতকাল বুধবার দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তনুর পরিবার সিআইডি কার্যালয়ে অবস্থান করে।

এর আগে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তনু হত্যার বিচার নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

“তদন্তের অংশ হিসেবে তনুর পরিবারকে ঢাকায় আনা হয়েছে। আমি মনে করি সিআইডির তদন্তে সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত হবে,” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন।

এদিকে সন্ধ্যায় সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তনুর বাবা মো ইয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, তাঁরা ন্যায়বিচার চেয়েছেন।

“আমি, তনুর মা, ওর দুই ভাই ও আমার ভাইয়ের মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। আমরা অপরাধীদের বিচার চেয়েছি,” বলেন ইয়ার হোসেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি এর বেশি কিছু বলতে চাননি।

তনু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তনুর মা আনোয়ারা বেগম তাঁর মেয়ের মৃত্যুর জন্য কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন সার্জেন্ট জাহিদ ও তাঁর স্ত্রী, সিপাহি জাহিদ ও সার্জেন্ট তাজুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিলেন।

এর আগে গত ২৪ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত টানা তিন দিন সন্দেহভাজন তিন সেনাসদস্যকে ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডির তদন্তকারী দল। তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জালাল উদ্দিন এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

“তনুর পরিবার যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে দফায় দফায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কতটুকু জানা গেছে, তদন্তের স্বার্থে সে সম্পর্কে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না,” বেনারকে বলেন মো. জালাল উদ্দিন।

হত্যাকাণ্ডে কতজন অংশ নিয়েছিলেন, সেনানিবাসের বাইরের কেউ ছিলেন কি না এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।

পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাত ঘুরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নানা কারণে মামলাটির তদন্ত জটিল। প্রথমত, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করেনি। উদ্ধার হওয়ার পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে মৃতদেহটি পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের পরও তনুর মৃত্যুর কারণ চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করতে পারেননি।

গত বছরের ২০ মার্চ সোহাগী জাহান তনু ১২ ইঞ্জিনিয়ার স্টাফ কোয়ার্টার ও ৬ বীর স্টাফ কোয়ার্টারে টিউশনি করতে যান। সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে তনু বাড়ি ফিরতেন। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার পরও তনু যখন ফিরছিলেন না, তখন প্রথমে তাঁর মা আনোয়ারা বেগম ও পরে রাত সোয়া ১০টা দিকে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন মেয়েকে খুঁজতে বের হন।

খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে ৩-৪ শ গজ দূরে পাওয়ার হাউস এলাকার কালভার্টের ওপর তনুর স্যান্ডেল, পাশে মুঠোফোন ও আরও প্রায় ২০/২২ গজ দূরে তনুকে অচেতন পড়ে থাকতে দেখা যায়।

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় তাঁকে নিয়ে সিএমএইচে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

তনু হত্যাকাণ্ডের পরই তদন্ত ও বিচার পাওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। একপর্যায়ে তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনও গড়ে ওঠে। তবে এখন পর্যন্ত এই মামলার অগ্রগতি সামান্য।

তনু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

তনুকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল। সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষাগারে আলামত পরীক্ষার পর পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। ওই পরীক্ষায় তনুর বাবা ও ভাইয়ের বাইরে, তিনটি ডিএনএ পাওয়া যায়।

তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত তদারকির দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে বর্ষীয়ান কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড, চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদারকি করেছেন এই কর্মকর্তা।

“তনু যে হত্যার আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সেটিরই কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আমরা নিশ্চিত তনু সে রাতে খুন হওয়ার আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। আমরা সিমেন অ্যানালাইসিস করে নিশ্চিত হয়েছি,”বেনারকে বলেন আবদুল কাহহার আকন্দ।

তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে আরও যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু বলে মনে হচ্ছে তা হলো তনুর কাটা চুল। হত্যার আগে তনুর আনুমানিক দু ফুট লম্বা চুল বিসদৃশভাবে কেটে ফেলা হয়। ওই চুলও সিআইডি আলামত হিসেবে জব্দ করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তার বাবা ইয়ার হোসেন।

পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় এই ঘটনাতেও কোনো নারীর উপস্থিতি থাকতে পারে বলে তদন্তকারীরা আশঙ্কা করছেন। তাঁদের ধারণা তনুকে হত্যার পর মৃতদেহটি টেনে ঝোপের ভেতর ফেলে রেখে যাওয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে, সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, তনুর পরনের কাপড় ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বালু লেগেছিল। তা ছাড়া তনুর বাম কানের ওপরের অংশে কাটা ও রক্তের দাগ, পরনের কামিজ ছেঁড়া, ডান হাঁটু ছেলা ছিল।

বিচার কি হবে?

সাম্প্রতিক এই অগ্রগতির পরও তনুর মা আনোয়ারা বেগম সংশয়ে। তিনি বলেন, অভিযুক্তদের পরিবর্তে বারবার তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের আগে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন।

“আমি তো বলেছি সার্জেন্ট জাহিদ, সার্জেন্ট তাজুল, সিপাহি তাজুল আর সার্জেন্ট জাহিদেও স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেই সবকিছু বের হয়ে আসবে। সেটা না করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু আমাদেরই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে,” আনোয়ারা বেগম বলেন।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) তনুর পরিবারকে আইনগত সহযোগিতা দিচ্ছে।

বিএনডব্লিউএলএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, দেড় বছর পর যে অগ্রগতি তা সন্তোষজনক নয়।

“আমরা চাই তনুর পরিবার ন্যায়বিচার হোক। কিন্তু এখনো পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়নি। এটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। তবে শেষ পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে শুনে স্বস্তি পাচ্ছি,” বেনারকে বলেন সালমা আলী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।