বিমানবন্দরে হামলাকারী যুবক মুখ খুলছে না, চিকিৎসা চলছে
2016.11.07
ঢাকা থেকে
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য সোহাগ আলীকে (২০) ছুরি মেরে হত্যাকারীর প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি। কী উদ্দেশ্যে সে ওই স্পর্শকাতর এলাকায় হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে তাও স্পষ্ট করা হয়নি।
যুবকটি কোনো জঙ্গি দলের সদস্য কী না, তাও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে তাঁর কর্মকান্ডের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন জঙ্গি হামলার মিল লক্ষ্য করা গেছে।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সোমবার দুপুরে বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত এই হামলার কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, হামলার ধরনের সঙ্গে জঙ্গিদের কর্মকান্ডের এক ধরনের মিল দেখা গেলেও এখন পর্যন্ত মোটিভ স্পষ্ট হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
এ বিষয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা হামলার কারণ ও হামলায় জড়িতের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেননি।
গত রোববার সন্ধ্যায় শিহাব (২০) নামে এক যুবকের হামলায় বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন আনসার সদস্য নিহত হন। ওই ঘটনায় আনসার ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) আরও তিন সদস্য আহত হন। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা ওই যুবককে আহত অবস্থায় আটক করেন।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, যুবকটি জঙ্গি দলের সদস্য কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সে নিজের নাম বলছে শিহাব। তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। যুবকটির আঙুলের ছাপ মিলিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার চেষ্টা চলছে।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে চিকিৎসা
আহত হামলাকারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি কেবিনে কড়া নিরাপত্তায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেই কেবিনে সোমবার দিনভরই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের আনাগোনা ছিল। সংবাদকর্মীদের কাছাকাছি যেতে দেওয়া হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক উল্টোপাল্টা তথ্য দিচ্ছে।
বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এজাজ শরীফ বেনারকে বলেন, “ওই যুবক তার নাম বলছে শিহাব। এ ছাড়া বিস্তারিত কোন পরিচয় দিতে চাচ্ছে না। অসুস্থ থাকায় তাকে বেশি চাপাচাপি করা হচ্ছে না।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন কৌশলে যুবকের পরিচয় জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন জেসমিন নাহার বেনারকে বলেন, “যুবকটির কথা-বার্তা বেশ স্বাভাবিক। তার মাথায় কাটা দাগ ছিল। সেখানে সেলাই দেওয়া হয়েছে। এক পায়ের উরুতে কাটাছেড়া ছিল, এর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়।”
পরিচ্ছন্নতাকর্মী নয়
বিমানবন্দর থানা-পুলিশ জানায়, হামলাকারীকে প্রথমে বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান এ কে ট্রেডার্সের কর্মী হিসেবে অনেকে মনে করেছিলেন। তার পরনের কাপড়ও ছিল অনেকটা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো।
প্রকৃতপক্ষে যুবকটি হলুদ গেঞ্জি ও কালো প্যান্ট পরা ছিল। এ কে ট্রেডার্স নিশ্চিত করেছে, পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রতিদিন তাদের ২৮৫ জন কর্মী কাজ করেন। কিন্তু ওই যুবকের নাম তাদের কর্মী তালিকায় নেই।
এ কে ট্রেডার্সের বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার মাসুদ রানা বেনারকে বলেন, “যুবকটিকে আগে কখনোই বিমানবন্দরে দেখা যায়নি। সে তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে না।”
লক্ষ্য ছিল নিরাপত্তা কর্মীরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার ধারণা হচ্ছে, বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে আতঙ্ক তৈরি করা তার লক্ষ্য হতে পারে। ভিডিও দেখা একজন কর্মকর্তা জানান, যুবকটি ড্রাইভওয়েতে ছুরি হাতে দৌড়ানোর সময় সাধারণ যাত্রীদের ওপর হামলা করেনি। তার লক্ষ্য ছিল, নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর সদস্যদের আঘাত করা।
ওই কর্মকর্তা জানান, ভিডিওতে দেখা যায়, লোকটি ছিল খুবই ক্ষিপ্র। তাঁর চেষ্টা ছিল বিমানবন্দরের টার্মিনালের ভেতরে ঢোকা। সব মিলিয়ে মনে হয় না যে, সে পাগল অথবা সাধারণ সন্ত্রাসী।
গুলি করেনি কেন?
ওই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে যে, যুবকটিকে এতদূর এগোনোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে কেন?
কারণ বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সব বাহিনীর সদস্যদেরই অস্ত্র রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, ভিড়ের মধ্যে গুলি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তা ছাড়া নিরাপদ পরিবেশ পেয়ে একবার গুলি চালালেও তা লক্ষ্যভ্রস্ট হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সূত্র জানায়, আনসার সদস্যরা যুবকটিকে ধরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। তারা ব্যাগ বহনের ট্রলি, লোহার পাইপ ইত্যাদি নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। শেষ পর্যন্ত টার্মিনালে ভেতরে তাকে ধরা সম্ভব হয়। এসময় সে ছুরি চালিয়েছে। এমনকি ধরে ফেলার পরেও সে ছুরি চালানোর চেষ্টা করছিল।
মামলা দায়ের, তদন্ত কমিটি
রবিবারের এ ঘটনায় গতকাল সোমবার আনসারের প্লাটুন কমান্ডার আশরাফুল আলম বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া শিহাবকে আসামি করা হয়েছে।
“মামলায় একজন আনসার সদস্যকে হত্যা, কয়েকজনকে আহত করাসহ সরকারি কাজে বাধা ও অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়েছে,” বেনারকে জানান বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আলম মিয়া।
ঘটনা তদন্তে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় থাকা বাহিনী এপিবিএনের সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি হাসিব আজিজকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ পৃথক তদন্ত কমিটি করেছে।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঘাটতি দিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ থেকে বিমানে সরাসরি পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ করে।
যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবারের পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তল্লাশির কাজে ব্রিটিশ একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান সোমবার রাতে বেনারকে জানান, মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রী এ ঘটনা ও বিমানবন্দরে নিরাপত্তা সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবেন।