বিচার শুরু হলো ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের
2019.06.20
ঢাকা
বিচারিক আদালতে ফেনীর সোনাগাজী থানার মাদ্রাসা অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে অভিযোগ গঠন হয়েছে বৃহস্পতিবার। আগামী ২৭ জুন থেকে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বৃহস্পতিবার হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ–উ–দৌলা (৫৭), স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা, মাদ্রাসার একজন শিক্ষক ও ১২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। ১৬ জনই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন।
গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ–উ–দৌলার সহযোগীরা পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় নুসরাতের গায়ে। শরীরের ৮০ শতাংশের ওপর পোড়া নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনসহ সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আসামিদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
“আজ আদালত মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করল। এর মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো,” ফেনী জেলার সরকারি কৌঁসুলি হাফেজ আহমেদ বেনারনিউজকে বলেন।
“আসামিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ এর এক এবং ৪ এর ১ এর ৩০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। আগামী ২৭ জুন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে,” হাফেজ আহমেদ বলেন।
এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বলেও জানান হাফেজ আহমেদ।
নুসরাত জাহান রাফির ভাই বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
“আমরা খুশি যে দ্রুত বিচারটা শুরু হলো। আমি ২৭ জুন আদালতে সাক্ষ্য দেবো। আমরা চাই অল্প দিনের ভেতরেই যেন বিচার শেষ হয়। নুসরাতের খুনিদের মৃত্যুদণ্ড চাই আমরা,” মাহমুদুল হাসান নোমান বেনারনিউজকে বলেন।
“আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের জন্য,” মাহমুদুল হাসান বলেন।
গতকাল অভিযোগ গঠনের সময় এজলাসে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বেলা সাড়ে ১১টায় আদালত বসে, চলে বিকেল ৪টা নাগাদ।
অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়াটা আসলে কী? এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন জানান, এ সময় আদালত আসামিদের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো পড়ে শোনান।
“এরপর আদালত জানতে চান, আসামিরা দায় স্বীকার করছেন না কি মামলা লড়তে চান। আসামিরা মামলা লড়তে চাইলে অভিযোগ গঠন হয়,” সৈয়দ সাইয়েদুল হক বলেন।
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ–উদ–দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
নূর উদ্দীনের (২৩) বিরুদ্ধে অভিযোগ নুসরাত জাহানকে হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেওয়াসহ সহযোগিতা করা।
নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা পরিকল্পনা ও হাত–পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণের অভিযোগ আনা হয়েছে পাঁচজনের বিরুদ্ধে। তাঁরা হলেন, শাহাদৎ হোসেন শামীম (২১), সাইফুর রহমান মো. জোবায়ের (২১), জাবদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াৎ হোসেন জাবেদ (১৯), কামরুন নাহার মণি (১৯) এবং উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯)।
হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পরিকল্পনা মাফিক বাস্তবায়নের জন্য মাদ্রাসা ফটকের বাইরে পাহারা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), মাদ্রাসার প্রভাষক আবছারউদ্দিন (৩৩), আবদুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মো. শামীম (২০), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২) ও মহিউদ্দীন শাকিল (২২) এর বিরুদ্ধে।
মাকসুদ আলম ওরফে মাকসুদ আলী কাউন্সিলর (৫০) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ, হত্যাকাণ্ড ঘটাতে ১০ হাজার টাকা দেওয়া ও হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে প্রচার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসামিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা।
যেভাবে অভিযোগপত্র
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার চার দিন পর। মোট ৫০ দিনে পিবিআই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামি গ্রেপ্তার করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এর সাথে রংতুলিতে আঁকা ১৩ পৃষ্ঠা সচিত্র ঘটনাপ্রবাহও সংযুক্ত ছিল।
পিবিআই মোট ৯২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। গ্রেপ্তার ১৬ আসামির ১২ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। অভিযোগপত্রে নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুকালীন জবানবন্দিও যুক্ত করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পিবিআই মোট ছয়টি বিশেষজ্ঞ সনদ অভিযোগপত্রে ব্যবহার করেছে।
গত ১০ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল অভিযোগপত্র গ্রহণ করে।
অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি
এই মামলার ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর এর ৪ (১)/৩০ ধারার অপরাধের অভিযোগ করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সরকারের মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলছিলেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে আসামিদের কঠোর সাজা হবে।
“যে ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সে ধারায় অভিযুক্ত মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন,” ফাহমিদা আক্তার বলেন।
আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ এর (১)/৩০ ধারার অপরাধ করার অভিযোগ দায়ের হয়ে থাকে।