নুসরাত হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
2019.06.27
ঢাকা
অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
প্রথম দিনে প্রথম সাক্ষ্য দিয়ে রাফিকে হত্যার মূলহোতা সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ বাকি ১৫ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছেন রাফির ভাই ও মামলার বাদি মাহমুদুল হাসান।
অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, রাফি নিজে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাঁকে হত্যা করা হয়নি।
এটাকে হত্যা মামলা আখ্যা দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি তালিাকভুক্ত করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
ফেনী জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর–পিপি হাফেজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “গত ২০ জুন ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর বৃহস্পতিবার প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান ও নুসরাতের দুই বান্ধবীর সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল। সময় স্বল্পতার কারণে শুধু মাহমুদুল হাসানের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।”
পিপি বলেন, “বেলা এগারোটার দিকে মাহমুদুল হাসান তাঁর জবানবন্দি দিতে শুরু করেন। তিনি প্রায় সোয়া ঘন্টা জবানবন্দি দেন। এরপর ১৬ আসামির আইনজীবীরা মাহমুদুল হাসানকে একে একে জেরা করেন।”
ষোল আইনজীবীর মধ্যে বৃহস্পতিবার মোট নয়জন মাহমুদুল হাসানকে জেরা করার সুযোগ পেয়েছেন—এই তথ্য জানিয়ে পিপি বলেন, আগামী রোববার পুনরায় মাহমুদুল হাসানকে জেরা করবে আসামিপক্ষের বাকি সাত আইনজীবী।
নুসরাত আত্মহত্যা করেছে: আসামিপক্ষ
হাফেজ আহমেদ বলেন, “আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে বলেছি যে, একজন ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার মতো জঘন্য ঘটনার জন্য দায়ী আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, “মাহমুদুল হাসান তাঁর জবানবন্দি শেষে বোনের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন।”
জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান বেনারকে বলেন, “আসামিপক্ষের আইনজীবীদের প্রায় সবাই আমাকে জেরা করার সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, নুসরাত আত্নহত্যা করেছে।”
তিনি বলেন, “আমি পরিষ্কার ভাষায় বলেছি, আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমার বোন সিরাজ-উদ-দৌলার নির্যাতনের শিকার হয়ে পুলিশের কাছে মামলা করায় প্রথমে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়া হয়। আমরা মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় নুসরাতকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।”
পিপি হাফেজ আহমেদ বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে রাফি হত্যাকাণ্ডের বিচার করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আসামীপক্ষের আইনজীবীরা।
এ প্রসঙ্গে আসামী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বলার চেষ্টা করেছি রাফিকে আমার মক্কেলরা হত্যা করেনি। সে আত্মহত্যা করেছে। একটি আত্মহত্যার মামলাকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে হত্যা মামলা বলে আমার মক্কেলদের ফাঁসানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এটি একটি হত্যা মামলা। এই মামলা নারী শিশু নির্যাতন দমন আদালতে হতে পারে না।”
বিচারকার্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ দেখতে আইনজীবী, নুসরাত রাফির পরিবার সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সদস্যরা ফেনীর নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে উপস্থিত ছিলেন।
মানবাধিকার কর্মী মালেকা বেগম তাঁদের একজন, যিনি আদালতে মামলা পর্যবক্ষেণ করতে ঢাকা থেকে ফেনী যান।
মালেকা বেগম বেনারকে বলেন, “আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম। সাক্ষ্যগ্রহণ দেখেছি। এখনো মামলার বিচার নিয়ে মন্তব্য করার সময় হয়নি।”
“তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, নুসরাত নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছিল। তার পরিবার তাকে বিষয়টি গোপন না রেখে মামলা দায়ের করতে বলেছে। আমার মতে, নুসরাত ও তার পরিবার এর মাধ্যমে একটি বড় কাজ করেছে,” বলেন মালেকা বেগম।
মালেকা বেগম বলেন, “তাকে যে হত্যা করা হয়েছে, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃত্যুর আগে রাফি নিজেই কীভাবে তার গায়ে আগুন লাগানো হয়েছে, তা বলে গেছে।”
মালেকা বেগম আশা করেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাফি হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে।
সব আসামি কারাগারে
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে।
রাফি বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এরপর রাফির মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। আদালত তার জামিন আবেদন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণ করে।
এরপর থেকে রাফি ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহার করার চাপ দিতে থাকে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা।
গত ৬ এপ্রিল রাফি পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে তাকে মিথ্যা কথা বলে একটি ভবনের ছাদে নেওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরা পাঁচ ব্যক্তি প্রথমে মামলা তোলার জন্য একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে।
রাফি আস্বীকৃতি জানালে ওই পাঁচ হত্যাকারী প্রথমে রাফিকে হাত পা বেঁধে মুখ চেপে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। হত্যাকারীদের তিনজন পুরুষ এবং দুইজন নারী।
অগ্নিদগ্ধ রাফি ছাদ থেকে নিচে পালিয়ে আসে। তবে তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায় বলে চিকিৎসকেরা জানান। ফেনী হাসপাতালে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১০ এপ্রিল রাতে চিকিৎসাধীন রাফি মারা যায়।
পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিহ্নিত করেছে। আসামিদের সবাই কারাগারে আটক রয়েছেন।
আইন বহির্ভূতভাবে রাফির ভিডিও সাক্ষাৎকার ধারণ ও তা প্রচার করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া পৃথক একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনও বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
রাফি হত্যা মামলায় অভিযুক্তরা হলেন: ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ–উদ–দৌলা, নূর উদ্দীন (২৩), শাহাদৎ হোসেন শামীম (২১), সাইফুর রহমান মো. জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াৎ হোসেন জাবেদ (১৯), কামরুন নাহার মণি (১৯) উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), মাদ্রাসার প্রভাষক আবছারউদ্দিন (৩৩), আবদুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মো. শামীম (২০), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মহিউদ্দীন শাকিল (২২), মাকসুদ আলম ওরফে মাকসুদ আলী (৫০) এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন।