স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা: প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর তৎপর পুলিশ
2019.06.28
ঢাকা
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় গত বুধবার প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ (২৫) নামে এক যুবককে তাঁর স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত ১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার একদিনের মাথায় শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
“আমাদের পুলিশ এবং গোয়েন্দারা অত্যন্ত দক্ষ। খুব শিগগির দেখবেন ১৩ জনের সবাইকে ধরে ফেলেছে,” ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে এক অনুষ্ঠান শেষে শুক্রবার এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“আমাদের নজর এড়িয়ে কেউ দেশ থেকে বের হতেও পারবে না,” যোগ করেন তিনি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে সরকার এতটা তৎপর হতো না।
এর আগে গত এপ্রিলে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায়ও তাঁর জবানবন্দি ‘ভাইরাল’ হওয়ার কারণে জনমতের চাপে খোদ সরকারপ্রধান হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। এপ্রিলের ওই ঘটনার পর দ্রুততার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার নুসরাত হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
“এ দেশে এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছুই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে হতে চায় না। যে কারণে এসব ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আতাউর রহমান।
“এটা সন্দেহ নেই যে এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে একটা ঘটনা এখন দ্রুত দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আর কিছু ঘটনা এভাবে সরকার ও প্রশাসনের নজরে পড়ছে,” বলেন তিনি।
রিফাত হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আয়েশাকে উত্ত্যক্ত করত সাব্বির
পুলিশ বলছে, সাব্বিরের সঙ্গে রিফাতের ব্যক্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে আগে থেকেই উত্ত্যক্ত করত সাব্বির। আয়শার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে—এ রকম কথাও সে পরিচিত মহলে প্রচার করে।
দুই মাস আগে আয়শার সঙ্গে রিফাতের বিয়ের পর সাব্বির ফেসবুকে নানা আপত্তিকর পোস্ট দেওয়া শুরু করে। বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নিহত রিফাত। এ বিরোধই শেষ পর্যন্ত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গড়ায় বলে পুলিশের ধারণা।
পুলিশ বলছে, নিজের বিরোধের প্রতিশোধ নিতে সাব্বির তাঁর বন্ধু ও সহযোগিদের সাহায্য নেয়। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজে এঁদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাও সাংবাদিকদের বলেছেন, ভিডিওতে থাকা ওই তরুণেরাই প্রথমে আটকে তাঁর স্বামীকে মারধর শুরু করেন।
মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, নিহত রিফাতকে লম্বা দা দিয়ে উপর্যুপরি কোপাচ্ছিল দুজন। এঁদের একজন সাদা জামা পরা সাব্বির। অন্যজন কালো জামা, কালো সানগ্লাস পরা রিফাত ফরাজী।
আরো দেখা যায়, রিফাত ফরাজীর ভাই রিশান ফরাজী ও তাঁর সহযোগিরা কলেজ মাঠ থেকে মারতে মারতে রিফাত শরীফকে কলেজের বাইরের রাস্তায় নিয়ে এসেছিল। এ সময় কলেজের সামনের রাস্তার উত্তর ও পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রিশানের সহযোগিরা।
বুধবার সকালে স্ত্রী মিন্নিকে নিয়ে কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে দুর্বৃত্তরা রিফাতের ওপর হামলা চালায়। তারা রিফাতকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়।
পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে গুরুতর আহতাবস্থায় বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রিফাতের মৃত্যু হয়।
আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
রিফাতের হত্যাকারীদের কেউ যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য দেশের সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌবন্দরে সতর্কতা (রেড অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে বলেও শুক্রবার জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল।
এর আগে বৃহস্পতিবার এই মামলার আসামিরা যাতে সীমান্ত অতিক্রম ও দেশ ত্যাগ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস ঘটনাটি নজরে আনলে আদালত বলেন, “ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। দেশের সবাই এ ঘটনায় মর্মাহত। সমাজটা কোথায় যাচ্ছে!”
একইদিন সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় কঠোর অবস্থানে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে জড়িতদের যে কোনো মূল্যে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গ্রেপ্তার তিন, দুজন রিমান্ডে
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন শুক্রবার বেনারকে টেলিফোনে বলেন, “এখন পর্যন্ত পুলিশ তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে দুই আসামি চন্দন ও হাসানের সাত দিন ও আরেক আসামি নাজমুল হাসানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।”
একইদিন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসপি বলেন, “অচিরেই দেশবাসীকে আমরা সুখবর দিতে পারব। কোনো আসামি গ্রেপ্তার এড়াতে পারবে না।”
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ঘটনাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।”
“পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে জেলা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই, সিআইডি, র্যাব ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কাজ করছে,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে বরগুনা শহরের মাইঠা এলাকায় নিহতের স্ত্রী মিন্নির বাড়িতে শুক্রবার দুপুর থেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ও তিনজন কনস্টেবল সেখানে নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব পালন করছেন।
নিহত রিফাত শরীফের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ছয় নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আ. হালিম দুলাল শরীফ। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি।
মোট ১২ আসামি
রিফাতের বাবা দুলাল বৃহস্পতিবার ১২ আসামির নাম উল্লেখ করে বরগুনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিরা হচ্ছে; সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) (২৫), মো. রিফাত ফরাজী (২৩), মো. রিশান ফরাজী (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)।
বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড প্রতিনিয়ত ঘটছে। এরপরও সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে চাইছেন, যা দুঃখজনক।