পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যু: আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ

সুনীল বড়ুয়া ও শরীফ খিয়াম
2020.12.21
কক্সবাজার ও ঢাকা
পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যু: আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ সিনহা হত্যা মামলার তিন অভিযুক্তকে কক্সবাজার আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১২ আগস্ট ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় পুলিশের টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে র‌্যাপিড এ্যাকশান ব্যাটালিয়ানের (র‌্যাব) দাখিল করা অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছে আদালত। 

কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ সোমবার এটি গ্রহণের পর মামলার একমাত্র পলাতক আসামি পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সাগর দেবের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। 

তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গত ১৩ ডিসেম্বর আমরা আদালতে অভিযোগপত্রটি জমা দিয়েছিলাম। আজ শুনানি শেষে আদালত এটি গ্রহণ করে পলাতক অভিযুক্ত সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।” 

মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের আইনজীবি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বেনারকে বলেন, “সাগর দেব যদি আত্মসমর্পন না করেন তবে আদালত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করবে।” 

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর মধ্যেকার ক্ষোভ-বিক্ষোভের কারণেই দ্রুততম সময়ে এই ঘটনার তদন্ত হয়েছে। একই কারণে বিচার প্রক্রিয়াও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাবে। 

“কিন্তু গত দুই দশকে দেশে আরো কয়েক হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রত্যেকটি ঘটনার তদন্তের ব্যাপারে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত এলেও আমরা আশাবাদী হতে পারতাম,” বলেন তিনি। 

ইয়াবা বাণিজ্যে ওসি প্রদীপের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মেজর সিনহা তাঁর রোষানলে পড়েন বলে অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে জানান আইনজীবী জাহাঙ্গীর। 

তিনি বলেন, “সিনহাকে প্রদীপ এলাকা থেকে চলে যেতে বলেছিলেন। না যাওয়ায় প্রথমে ডাকাত বলে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। ব্যর্থ হয়ে একদম পরিকল্পিতভাবে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়।”  

অভিযোগপত্রে টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১৪ জনই বর্তমানে জেল হাজতে। তাঁদের ১১ জন পুলিশ সদস্য ও তিন জন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করা গ্রামবাসী। 

একইদিন “সিনহার সহযোগী সাইদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে মাদক রাখা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা দুটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদালত মামলাগুলো থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে,” বেনারকে বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা খাইরুল। 

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম সাংবাদিকদের জানান, রামু থানায় পুলিশের দায়ের করা মাদক আইনের মামলায় সিনহার আরেক সহযোগী শিপ্রা দেবনাথকেও নির্দোষ জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। আগামী ২৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। 

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৬) চেকপোস্টে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা। ওই সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। 

এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকারী দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করা হয়।

নূরকে তখন ছেড়ে​ দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান। 

ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। তিনটি মামলার দুটি মাদক রাখার অভিযোগে এবং একটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে। 

পরবর্তীতে ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ পুলিশের নয় সদস্যকে আসামি করে ৫ আগস্ট আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন সিনহার বোন শারমিন।

আদালত র‌্যাবকে সবগুলো মামলা তদন্তের নির্দেশ দেয়। ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতসহ পুলিশের সাত সদস্য ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। 

পরে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে নতুন করে আসামি হিসেবে টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেবের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। 

প্রসঙ্গত, সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজার পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা-প্রতিক্রিয়া শুরু হলে সেপ্টেম্বরে চার দফায় কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের এক হাজার ৪১৩ পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করা হয়।

তার আগে ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান এবং পুলিশ বাহিনীর প্রধান যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, পুলিশ এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মোট ২২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।