এবার কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধাকে গলা কেটে হত্যা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.22
160322_BD_ATTACK_REAX_620.jpg হোসেন আলী সরকারকে হত্যার খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজনেরা।
Photo: Benar

স্বাধীনতার মাস মার্চে দুর্বৃত্তরা মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী সরকারকে (৬৮) গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, যিনি মুসলমান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে​ছিলেন। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মচারী হিসেবে অবসর নেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের  দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহে দুই হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক (৫০) ও ছামির আলীকে (৮২)  হত্যা  করা হয়, এদের একজন  শিয়া মতাদর্শে,  অপরজন খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

এই দুটি হত্যার দায় স্বীকার করেছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যদিও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আইএস এর এসব দাবি সঠিক নয়।

এ পর্যন্ত দুই বিদেশিসহ প্রায় এক ডজন হত্যার দায় আই এস স্বীকার করলেও সরকার জঙ্গিদের ওই দাবি মানতে নারাজ। আবার  ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি।

যেভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ড

মঙ্গলবার উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রাম শহরের গাড়ীয়াল পাড়ায় নিহত হন হোসেন আলী।তাঁর বাড়ির কাছে কুড়িগ্রাম-মোগলবাসা সড়কে সকাল সাতটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ওই বৃদ্ধের গলা কাটার পর দুর্বৃত্তরা ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, এরপর পালিয়ে যায়।

এ ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবিরের তিন কর্মীকে গতকালই আটক করেছে পু‌লিশ। এঁরা হলেন; কু‌ড়িগ্রাম সরকারি কলেজ শাখার শি‌বির সভাপতি মোস্তা‌ফিজুর রহমান (২২),‌ শিবিরের সমর্থক শ‌রিফুল ইসলাম(২০) ও জা‌হিদুল ইসলাম (১৮)। তাদের তিনজনের বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায়।

“ওই তিনজনকে শহরের গা‌ড়ীয়াল পাড়ার ‘শিবিরের মেস’ বলে পরিচিত আদর্শ ছাত্রাবাস থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান সদর থানার অফিসার ইনচার্জ বজলুর র‌শিদ।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, হাঁটা শেষ করে বাসায় ফেরার পথে সকাল সাতটার দিকে তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ২০ গজ দূরে আশরাফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে মোটরসাইকেল আরোহী তিনজন তাঁর গতি রোধ করে। একজন নেমে তাঁর গলা কাটতে শুরু করে।

এ সময় এক পথচারী ঘটনাস্থলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দুর্বৃত্তরা তাঁকে ছুরি উঁচু করে ভয় দেখায়। আরেক দুর্বৃত্ত ককটেল নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জবাই শেষ করে তিনজনই মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়।

এ সময় আশপাশের লোকজনের চিৎকারে পূর্ব কলেজ পাড়ার সড়কের অপর মাথায় গাছ ফেলে দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করে এলাকাবাসী। দুর্বৃত্তরা তখন ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

পারিবারিক সূত্র জানায়, নিহতের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের নয়ারহাট গ্রামে। তিনি ১৯৯৮ সালে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।

“পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সেটি উগ্রবাদী জঙ্গিরা করতে পারে, আবার পূর্ব শত্রুতার কারণেও এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত ও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে,” স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ।

তবে নিহতের পরিবার দাবি করেছেন, হোসেন আলীর কোনো শত্রু ছিল না।

“কারও সঙ্গে আমার বাবার মনোমালিন্য থাকার কথা আমরা জানি না। উনি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতেন না। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলেন,” টেলিফোনে বেনারকে জানান নিহতের একমাত্র পুত্র রাহুল আমিন আজাদ।

গার্ড অব অনার

মঙ্গলবার কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর বিকেল ৫টায় নিহতের লাশ স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত শত শত নারী-পুরুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নেই। ওর অসীম সাহসী ছিল। তাঁকে  কখনো অন্যায় করতে দেখিনি,” বেনারকে জানান নিহতের যুদ্ধকালীন সহকর্মী জাভেদ আলী  ।

বিকেল সাড়ে ৫টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে গাড়ীয়াল পাড়ায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

নতুন মাত্রায় হত্যাকাণ্ড

দেশে নতুন মাত্রায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয় গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এই হত্যার পরপর টুইটারে আইএসের নামে দায় স্বীকার করা হয়। মূলত এরপরই দেশে আইএসের অস্তিত্ব থাকা না-থাকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

যদিও তার আগ পর্যন্ত আইএসের ‘সমন্বয়ক’ বা ‘সদস্য’ দাবি করে অনেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হলেও তখন তা নিয়ে সরকারের কেউ প্রশ্ন তোলেননি।

তাবেলা হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ৩ অক্টোবর একই কায়দায় রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা এবং আইএসের দায় স্বীকারের পর সরকারের পক্ষ থেকে আইএসের কথিত দাবিকে আরও জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং এসব হত্যার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করা হয়। উভয় ঘটনায় বিএনপি-সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

এরপর ৪ অক্টোবর ঈশ্বরদীতে খ্রিষ্টান যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা ও পরদিন ঢাকায় খিজির খানকে তাঁর খানকায় জবাই করে হত্যা করা হয়। ২২ অক্টোবর ঢাকার দারুস সালামের তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা, পরদিন আশুরার রাতে ঢাকায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হোসেনি দালানে বোমা হামলা করে।

৩১ অক্টোবর আজিজ মার্কেটে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিনকে হত্যা করা হয়। একই দিন লালমাটিয়ায় আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরীসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা।

এরপর গত ৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তল্লাশিচৌকিতে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যাসহ একই দিন দিনাজপুরে ইতালীয় ধর্মযাজককে, ৮ নভেম্বর রংপুর শহরে বাহাই কেন্দ্রের পরিচালক রুহুল আমিন ও ১২ নভেম্বর সৈয়দপুরে প্রতীকী কারবালায় শিয়া সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

তার আগে ১০ নভেম্বর রংপুরের কাউনিয়ায় এক মাজারের খাদেমকে হত্যা করা হয়। ২৬ নভেম্বর বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা হয়।সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহে দুই হোমিও চিকিৎসক ছামির আলী (৮২) এবং ১৪ মার্চ আবদুর রাজ্জাককে (৫০) হত্যা  করা হয়েছে।আর মঙ্গলবার খুন হলেন হোসেন আলী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।