ফাঁকা ময়দানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন উৎসব
2023.11.21
ঢাকা
বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লড়তে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন হাজার হাজার ব্যক্তি। দলটির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন এমন অনেকেও সংগ্রহ করেছেন মনোনয়নপত্র। এদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান, চলচ্চিত্রশিল্পী, একাধিক সাংবাদিক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারাও।
ক্ষমতাসীন দল ও দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা যখন পূর্ণোদ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, বিরোধী শিবিরে তার বিপরীত চিত্র। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। জ্যেষ্ঠ নেতারা সহ তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী এখন কারাগারে। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকেই পলাতক। এমনকি দলটির প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত তালাবদ্ধ।
“আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দলের এবং দলের বাইরের ব্যক্তিদের তুমুল আগ্রহই প্রমাণ করে, নির্বাচন বা ভোটার নয় বরং ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে,” বেনারকে বলছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামে একটি নাগরিক সংগঠনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
“একতরফা ভোট, পেশী শক্তির চরম ব্যবহার ও ভোটারদের প্রতি চূড়ান্ত অসম্মানের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, এখন আর প্রার্থীর কাছে ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নই সব।”
বিক্রি হলো তিন হাজারেরও বেশি ফরম
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত চার দিনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ৩,৩৬২টি ফরম সংগ্রহ করছেন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্বালে দলটি চার হাজারেরও বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছিল।
গত কয়েকদিনে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে হাজার হাজার মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তাদের প্রতিনিধিরা মনোনয়ন সংগ্রহ করতে আসেন। কারো কারো সঙ্গে মিছিল সমেত উপস্থিত ছিলেন অসংখ্য নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এই সময় যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল।
এবার আওয়ামী লীগ প্রতিটি ফরম বিক্রি করেছে ৫০ হাজার টাকায়, যা গতবারের চেয়ে ২০ হাজার টাকা বেশি। বিপ্লব বড়ুয়া জানান, মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে দলের আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
দলটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৭৩০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৫৯টি, রাজশাহীতে ৪০৯টি, খুলনায় ৪১৬টি, রংপুরে ৩০২টি, ময়মনসিংহে ২৯৫টি, সিলেটে ১৭২টি এবং বরিশাল বিভাগে ২৫৮টি।
এই হিসাব অনুযায়ী দেশের ৩০০টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা গড়ে ১১ জনের বেশি।
মনোনয়ন দৌড়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা
নিয়মিত রাজনীতিবিদদের বাইরে ক্রিকেটার, চলচ্চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান মাগুরা-১ ও ২ এবং ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিনিধি হয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তবে এবার তিনি নেত্রকোণা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে লড়তে চান। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তার ছোটো ভাই ওয়ারেস হোসেন বেলাল।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ও নির্বাচন কমিশন গঠনের অনুসন্ধান কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সাদিক সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান।
একইভাবে নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজাম ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রকাশক একে আজাদও ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। একাধিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিক একে আজাদ বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীও।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান, সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়, সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন, সাবেক সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন রয়েছেন প্রার্থীতার লড়াইয়ে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে দৃশ্যত অরাজনৈতিক ব্যক্তিবিশেষের সংশ্লিষ্টতা অস্বাভাবিক নয়। প্রায় সকল প্রধান রাজনৈতিক দলই কমবেশি সাবেক আমলা, পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দিয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন এবার এই প্রবণতার একটি আলাদা দিকও রয়েছে।
“আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কেনার এই হিড়িকের অন্যতম কারণ হলো, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, ‘নৌকা প্রতীক পাওয়া মানেই পাস’,” তার ভাষ্য।
“এই তৎপরতা রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। এভাবে উচ্চমূল্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি রাজনীতিকে পর্যায়ক্রমে প্রকৃত রাজনীতিকের কাছ থেকে লুটেরা-ধনীদের কাছে নিয়ে যাবে।”
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
“দলের নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী যে কেউ মনোনয়ন চাইতে পারেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে কাকে-কোথায় মনোনয়ন দেওয়া হবে,” বেনারকে বলেছেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতা।
গত ১৫ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশিরভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। দলগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো ধরণের রাজনৈতিক সমঝোতা না থাকা সত্ত্বেও এই তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বাইরে প্রথম সারির দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে, যদিও দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি।
এদিকে “দুর্নীতিবাজ” ব্যক্তিদের মনোননয়ন না দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।
মঙ্গলবার ঢাকায় নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এই আহবান জানান।
তিনি বলেন, “পৃথিবীর বহু দেশেই দুর্নীতি রয়েছে কিন্তু দুর্নীতিবাজ নেতা নেই। আমি প্রত্যাশা করবো আমাদের এখানেও যেন এমন লোক নেতৃত্বে না আসেন, যারা দুর্নীতিবাজ।”