ভারতের বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যান্ডউইথ দিল বাংলাদেশ
2016.03.23
ঢাকা
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে জাতীয় গ্রিডে আরও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভারতও পাবে ১০ জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ।
বিদ্যুৎ ও ব্যান্ডউইথ বিনিময়কে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেছেন দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী। বুধবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ত্রিপুরা-কুমিল্লা আন্তর্দেশীয় গ্রিড এবং ব্যান্ডউইথ রপ্তানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে মোদী এবং ঢাকা থেকে শেখ হাসিনা বোতাম চেপে এই বিনিময় কার্যক্রম শুরু করেন।
যা বললেন দুই প্রধানমন্ত্রী
বিদ্যুৎ ও ব্যান্ড উইথ উদ্বোধনের শুরুতে ভিডিও কনফারেন্সের কথা বলেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এই বিনিময়কে ‘মাইলফলক’ বলে অভিহিত করে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমদানি করা বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে। আর বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ পাওয়ার ফলে ত্রিপুরা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে ডিজিটাল সংযোগ বৃদ্ধি পাবে।
“আমাদের সহযোগিতার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে আন্তযোগাযোগের সম্প্রসারণ। শুধু বস্তুগত সংযোগই নয়, আমরা দুই দেশের মধ্যে ভার্চ্যুয়াল সংযোগ, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, চিন্তা-চেতনার যোগাযোগসহ সকল ধরনের সংযোগ স্থাপন করতে চাই,” উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ উল্লেখ করে দিল্লির প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সে নরেন্দ্র মোদী বলেন, “দুনিয়ায় এমন মুহূর্ত কমই আসে যখন দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ও একজন মুখ্যমন্ত্রী মিলে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কোনো কিছুর উদ্বোধন করলেন। এ দিক থেকে এটি খুবই মহত্বপূর্ণ দিন। আমরা দুই দেশ মিলে বিশ্বের সামনে একটি উদাহরণ তৈরি করছি।”
প্রয়োজনে ভারত ও বাংলাদেশ আরও বিদ্যুৎ ব্যান্ডউইথ বিনিময় করবে বলে সম্মত হন দুই প্রধানমন্ত্রী।
ইউনিট প্রতি সাড়ে ছয় টাকা মূল্যে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
ভারত থেকে আমদানি করা এই বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট খরচ পড়ছে প্রায় সাড়ে ছয় টাকা। ত্রিপুরার পালটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কুমিল্লার আন্তর্দেশীয় গ্রিড হয়ে দুই দেশের ৪০০ কিলো ভোল্ট লাইনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এই ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য দুই দেশ এ চুক্তি করেছে। তবে পরবর্তীতে তা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাচ্ছে ভারত ত্রিপুরা। বাস্তবায়নাধীন এসইএ-এমই-ডাব্লিউই-৫ কেবলেও ভারতে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ থাকবে।
এই ব্যান্ডউইথ রপ্তানির জন্য দুই দেশের আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ দেওয়া হচ্ছে দুটি লাইনের মাধ্যমে। যার প্রথমটি কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া হয়ে আগরতলায় যাবে। আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া হয়ে আগরতলা যাবে দ্বিতীয় লাইনটি।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরে দেশটির রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডের (বিএসএনএল) সঙ্গে ব্যান্ডউইথ রপ্তানির এই চুক্তি করে বিএসসিসিএল।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিদ্যুতের প্রতি বিশেষ জোর দিয়ে আসছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। বিদ্যুৎ আমদানি, নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ আরও প্রকল্প অনুমোদন, বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ পাবে নতুন ১৫ লাখ গ্রাহক
শহরের পাশাপাশি গ্রামকেও আলোকিত করার ব্রত নিয়ে সারা দেশে নতুন ১৫ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনবে সরকার। প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পল্লি বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক সংযোগ’ প্রকল্পের মাধ্যমে এ লক্ষ্য পূরণ করা হবে। এর আওতায় প্রায় ৪৪ হাজার কিলোমিটার সরবরাহ লাইন নির্মাণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে।
গত ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, “পল্লি বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক সংযোগ’ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালে। এটি বাস্তবায়িত হলে দেশের মোট ৮২ ভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় আসবে।”
বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে। জানা যায়, নতুন এ প্রকল্পটির আওতায় ৪৪ হাজার কিলোমিটার সরবরাহ লাইন ছাড়াও ৮৩টি নতুন উপকেন্দ্র স্থাপন ও ৩৫টি উপকেন্দ্র আপগ্রেড করা হবে।
আরও পাঁচটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র
এদিকে সরকারি খাতে আরও পাঁচটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। যেগুলো ৭৫৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। চলতি মাসে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ফার্নেস তেলভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চট্টগ্রামের জুলদা ও পটিয়ায় হবে বলে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “এগুলো প্রতিটিই ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হবে ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য একটি কেন্দ্র। এটিও ফার্নেস তেলভিত্তিক। বাকি দুটির মধ্যে একটি ৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, যা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় নির্মাণ হবে। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে ভোলায়। এটি ২২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কম্বাইন্ড সাইকেল ডুয়েল-ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এ ছাড়া রূপপুরে রাশিয়ার সহায়তায় পরমাণু জ্বালানিকেন্দ্র নির্মাণও চলছে। রয়েছে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও। ভারতের বিখ্যাত রিলায়েন্স কোম্পানি তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। যেগুলোর প্রতিটির সক্ষমতা ৭৫০ মেগাওয়াট।
একটি আলোকিত গ্রামের গল্প
সাতক্ষীরা জেলার মহিষাডাঙ্গা গ্রাম। সদর থানার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও শত বছর ধরে অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে এ গ্রামের শতাধিক পরিবারকে। তবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের উদীয়মান ক্রিকেটার সৌম্য সরকারের বদৌলতে মহিষাডাঙ্গা গ্রামের ১৬২ পরিবারের পাশাপাশি আশপাশের আরও ৪ গ্রামের ৪’শ পরিবারে সরকার পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যুতের আলো। আর আলো পেয়ে জীবনযাত্রাই যেন পাল্টে গেছে এখানকার বাসিন্দাদের।
বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দা রাজীব ব্যানার্জি বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ আসার পর গ্রামগুলোতে পোলট্রি শিল্পের বিকাশসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়েছে। ফলে অনেকেরই বেকারত্ব ঘুচেছে। এ ছাড়া এলাকাবাসীর জীবনমান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে নতুন পাওয়া বিদ্যুৎ। এ ভালো লাগা বলে বোঝানোর নয়।”
সক্ষমতা বাড়লেও সুবিধাভোগী বাড়েনি
২০০৯ সালের পর থেকে গত ছয় বছরে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও বিদ্যুতের সুবিধাভোগী খুব বেশি বাড়েনি বলে আন্তর্জাতিক এক জরিপে উঠে এসেছে।
প্যারিসভিত্তিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক-২০১৫ এর মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় রয়েছে মাত্র ৬১ শতাংশ জনগোষ্ঠী। আর এখনো বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে ছয় কোটি মানুষ।
ওই জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল ৫৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। তবে ২০১৫ সালে ৬ শতাংশ বেড়ে তা ৬১ শতাংশ হয়েছে।
তবে আইইএ’র জরিপ অস্বীকার করে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বেনারকে জানান, তাদের এ হিসাব সঠিক নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় রয়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতভাগ জনগোষ্ঠীকে যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, শহরের পাশাপাশি গ্রামকেও বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া এখন সরকারের অন্যতম টার্গেট। এ জন্য আরও ১৫ লাখ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামী দুবছরের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হবে। এটা অনেক বড় একটি সুখবর। এর ফলে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতা লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছাবে।