তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শ্রমিকরা
2025.02.03
ঢাকা

গত ৩১ বছর ধরে জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ করছেন আনিসুর রহমান (৪৮)। এই শিল্পে স্বল্প মজুরিতে শ্রমিকরা মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ থেকে লোহা সংগ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন।
আনিস একটি ইয়ার্ডে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেয়ার আগে বহু শ্রমিকের মত ব্লো-টর্চ দিয়ে পুরনো জাহাজের প্লেট কাটার কাজ করতেন। ২০১৬ সালের অ্যাসবেসটোসিসে আক্রান্ত আনিস মনে করেন, জাহাজ কাটার সময় নির্গত বিষাক্ত পদার্থই তাঁর এই রোগের জন্য দায়ী।
মূলত, বাতাসে ভেসে থাকা অ্যাসবেসটস শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ রোগ হয়।
আনিসের মতো হাজার হাজার শ্রমিক নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এই জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ করেন। এসব ঝুঁকির কারণ, মূলত যে জাহাজ তারা ভাঙেন, সেসব জাহাজে তেজস্ক্রিয় ও অ্যাসবেসটসসহ নানাবিধ বর্জ্য থাকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন অমান্য করে সীতাকুণ্ডের ইয়ার্ডে এসব জাহাজ ভাঙা হচ্ছে।
১৯৯৩ সালে জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ শুরু করা আনিস বেনারকে বলেন, “এক দশক আগে থেকে আমার ক্রমাগত কাশি হতো, ২০১৬ সালে অ্যাসবেসটোসিস ধরা পড়ে। আসলে আমার কাজের ধরনের কারণে আমাকে এ বিষাক্ত পদার্থের ভেতরেই কাজ করতে হতো।”
শিল্প মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বেনারনিউজের সংগ্রহ করা ফ্লোটিং স্টোরেজ অফলোডিং (এফএসও) এবং ফ্লোটিং প্রোডাকশন স্টোরেজ অফলোডিং এর (এফপিএসও) তালিকায় দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৫ টি তেজস্ক্রিয় বর্জ্যবাহী জাহাজ ভাঙা হয়েছে।
এফএসও ও এফপিএসও মূলত সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও সংরক্ষণ করে। এ প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের শিলাস্তরে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ যা নর্ম বা ন্যাচারালি অকার্ড রেডিও এ্যাকটিভ ম্যাটেরিয়ালস নামে পরিচিত এসব জাহাজের বিভিন্ন কাঠামোতে জমা হয়।
এ নর্ম অপসারণ করতে বিশেষায়িত এক্সপার্ট আর সরঞ্জাম লাগে যা পরিবেশ অধিদপ্তর ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের নেই বলে বেনারকে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা।
নর্ম একটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পদার্থ যার মধ্যে থাকতে পারে থুরিয়াম, ইউরেনিয়াম ও রেডিয়ামের মতো বর্জ্য। পৃথিবীর ভূ-ত্বক, মাটি, পানির মধ্যে নর্মের উপস্থিতি পাওয়া যায়। পরিবেশে স্বল্পমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি থাকতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি বলছে, উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি হাড়ের ক্যান্সার, কিডনি নষ্ট, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, প্রজননস্বাস্থ্যে ব্যাঘাতসহ উচ্চক্ষতির মুখে ফেলতে পারে যে কাউকে।
এখানেই আনিসের দুর্ভোগ শেষ হয়নি। গত বছর আনিসকে চোখের ছানি অপসারণ করতে হয়েছে। আনিস মনে করেন জাহাজভাঙা শিল্পের শুরুর দিনগুলোতে গ্যাস কাটারে উচ্চ ঝলকানির কারণে চোখে ছানি পড়েছে তাঁর।
“পাঁচ সদস্যের পরিবারে আমি যা আয় করি সব আমার চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন ভাবছি চিকিৎসা বন্ধ করে দিব। যৎসামান্য টাকা দিয়ে এ চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব,” বলেন তিনি।

আট মাস আগে এক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে প্রায় শয্যাশায়ী হয়েছেন আরেক জাহাজভাঙা শ্রমিক মো. মিজান। তিনি বেনারকে বলেন, “আমি ১৩ থেকে ১৪ বছর দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেতনে জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ করেছি যা দিয়ে আমার পরিবার চলত না।”
জিসান জানান, কর্মস্থলে মিজান ও সহকর্মীদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম তো দুরের কথা একটা মাস্ক পর্যন্ত দেয়া হতো না। শ্রমিকরা নিজেদের ঘর থেকে কাপড় দিয়ে বানানো মাস্ক ব্যবহার করতেন।
“আমি গত আট মাস ধরে কাজ করতে পারছি না। আমার বুকের ও পিঠের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে গেছে। জীবন এখন আমার জন্য অনেক কঠিন,” বলেন মিজান।
নর্থ সি প্রোডিউসারে তেজস্ক্রিয়তা
যে বছর অ্যাসবেসটোসিস ধরা পড়ল, সে বছরই নর্ম নামক বিষাক্ত পদার্থ সম্পর্কে জানতে পারেন আনিস। “নর্থ সি প্রডিউসার” যখন ২০১৬ সালে ভাঙার জন্য আনা হয় তখনই আনিস জানতে পারেন জাহাজে থাকা তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে। সরকারি এক তদন্তে প্রথমবারের মতো জাহাজের তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। উচ্চ আদালত থেকে গঠন করে দেয়া কমিটি নর্থ সি প্রোডিউসারে তেজস্ক্রিয়তার সন্ধান পায়।
বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ কামাল ওই তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন। তিনি বেনারনিউজকে বলেন, ওই তদন্তে নর্থ সি প্রোডিউসারে অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে মাত্রাবহির্ভূত তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গিয়েছিল।
“ওই জাহাজের পাইপে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা পেয়েছিলাম আমরা। এসব এফএসও এবং এফপিএসওতে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন থাকার সম্ভাবনা থাকে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী এসব জাহাজ এখানে আসার কথা না,” যোগ করেন মাসুদ কামাল।

জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওদের আন্তর্জাতিক জোট “এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের” মতে একই বছর (২০১৬) উচ্চ আদালত জাহাজভাঙা ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ভঙ্গ করায় জাহাজভাঙা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলিং জারি করেন।
১৯৯২ সালে বিপজ্জনক বর্জ্যের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হওয়া বাসেল কনভেনশনে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এই কনভেনশন অনুযায়ী উন্নত দেশ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে বিপজ্জনক বর্জ্য স্থানান্তর করতে পারবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ ও শিল্প-এই দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বেনারকে জানিয়েছেন, ২০২১ সালে আমদানীকারকদের জন্য জাহাজের বিপজ্জনক বর্জ্যের তালিকা (আইএইচএম) জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করলেও সে তালিকা ধরে জাহাজের কাঠামোতে বর্জ্য শনাক্ত করার কারিগরি সক্ষমতা তৈরি করা যায়নি। আইএইচএম হলো জাহাজের কোথায় কোন ধরনের বর্জ্য আছে সে বিষয়ক একটা তালিকা।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারনিউজকে বলেন, এসব এফএসও ও এফপিএসও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ভাঙতে গেলে বিশেষ ধরনের উচ্চ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন সেট-আপ লাগে যা খুবই জটিল।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “ঠিক এ কারণে উন্নত বিশ্ব এগুলোকে ভাঙতে চায় না। কিন্তু আমাদের এখানে আগের সরকার এগুলোর ভাঙার অনুমতি দিয়েছে যা তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের একটা ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও উপকূলবাসীর জন্য।
“অসাধু ব্যবসায়ী শ্রমিকদের জীবনের বিনিময়ে এসব জাহাজ ভাঙার আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন। আমরা এসব জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিব,” বলেন রিজওয়ানা হাসান।

ওয়াচডগ রিপোর্ট
২০২৩ সালে এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম ও হিউম্যান রাইট ওয়াচ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপিয়ান জাহাজ কোম্পানিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ বাংলাদেশে পাঠাতে “সুবিধাজনক ফ্ল্যাগ”র আশ্রয় নিচ্ছে, যা ফ্ল্যাগ অব কনভেনিয়েন্স নামেও পরিচিত। ফ্ল্যাগ অব কনভেনিয়েন্স মূলত জাহাজের মালিকানায় থাকা দেশের পরিবর্তে অন্য দেশের ফ্ল্যাগের ব্যবহার যার ফলে মূল দেশ তার দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে।
রিপোর্টে বলা হয়, এ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয় মূলত এসব জাহাজ ইউরোপিয়ান ইয়ার্ডে ভাঙার যে বাধ্যবাধকতা সেটাকে এড়ানোর জন্য।
২০১৩ সালে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীদের স্বাধীন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়েশন প্রোটেকশন অ্যাসোশিয়েসন “অকারেন্স অব নর্ম ইন এফপিএসও ইউনিট: ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ডিসিশন মেকিং ফ্যাকটরস ফর রিসাইক্লিং ডেসটিনেশন আফটার ডিকমিশনিং” শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে এসব তেজস্ক্রিয় বর্জ্যবাহী জাহাজ ভাঙ্গার উন্নত ও আধুনিক ও কারিগরি সক্ষমতা সম্পন্ন ইয়ার্ড আছে হাতেগোনা।

নর্মের উপস্থিতির কারণে এসব জাহাজের রিসাইক্লিং খুবই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে ওই গবেষণায় বলা হয়।
জাহাজভাঙা শিল্পকে নিরাপদ করতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত এনজিওদের বৈশ্বিক জোট ‘এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের’ দক্ষিণ এশিয়ার পলিসি অফিসার সারা ডি কস্টা বেনারনিউজকে বলেন, এসব জাহাজ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহার শেষে যখন তাদের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যায়, তখন এগুলোর অভ্যন্তরে তেজস্ক্রিয়তায় পূর্ণ হয়ে থাকে। এসব বর্জ্য পরিষ্কার করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
“শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সনদ আছে এমন ইয়ার্ডে এসব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণ করতে পারে। এটা সবাই জানে যে বাংলাদেশে এসব বর্জ্য অপসারণ করার মত সামর্থ্য নেই,” বলেন তিনি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজভাঙা ও রিসাইক্লিং শাখার উপসচিব নুরুন নাহার বেনারকে বলেন, গ্রিন পিস নামের এনজিও’র তৈরি করা বিষাক্ত জাহাজের তালিকা তাদের কাছে আছে। তালিকায় থাকা কোনো জাহাজকে তারা দেশে আনার অনুমতি দেন না।
“সরকারি তিনটা সংস্থা ও একটি সেইফটি এজেন্সি নিয়ে গঠিত কমিটি জাহাজ পরিদর্শন শেষে ভাঙ্গার সুপারিশ করলে আমরা জাহাজ কাটার অনুমতি দিই,” বলেন তিনি।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্যসহ অন্যান্য ক্ষতিকর বর্জ্য পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণ করার মতো কারিগরি সক্ষমতা শিল্প মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বর্তমানে সে সক্ষমতা” তাঁদের নেই।