বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
2025.01.27
ঢাকা
আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫। ইস্টার্ন সময় দুপুর ১ টা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক নতুন প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, যেমন "স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতা" বন্ধ করতে হবে। নইলে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত কিছু ``গুরুত্বপূর্ণ’’ পদক্ষেপ ব্যাহত হতে পারে।
এতে বলা হয়, পুলিশ আবারো স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন বাছ-বিচার ছাড়াই ফৌজদারী মামলা দায়ের করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ যেকোন ব্যক্তিকে যে কোন অবস্থায় হয়রানি করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থান ও পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এইচআরডব্লিউ মঙ্গলবার ৫০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে তারা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সেই পুরানো নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফিরেছে, যা বাংলাদেশের জন্য 'সঙ্কটজনক'।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণহারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মতো ভূমিকা থেকে সরে আসার পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তার বন্ধ করতে বলেছে এইচআরডব্লিউ।
পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে সংস্কার করা এবং বেসামরিক তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি।
একই সাথে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে খামখেয়ালিভাবে ভিন্নমত দমনে যাকে-তাকে মামলায় আসামি করা ও মোটাদাগে অভিযোগ আনার সংস্কৃতি থেকে থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।
কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে দ্রুত ও নিরাপদে বিচারকের সামনে হাজির করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আদালতকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
"গ্রেপ্তারের পর থানা ও হেফাজতে রাখা কেন্দ্রগুলোকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা ও স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ রাখতে হবে।”

“সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, সামরিক ও বিচার বিভাগসহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ভূমিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে বলেছে এইচআরডব্লিউ। টেকসই সংস্কারে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) অনান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।"
একই সাথে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারকে দ্রুত গুম বিষয়ক অনুসন্ধান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বিশেষায়িত ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে (র্যাব) বিলুপ্ত করারও জোর দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি। অসংখ্য গুম-খুন-নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ ওঠে ওই বাহিনীর বিরুদ্ধে।
"বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারকে গত ১৫ বছরের আবদ্ধ স্বৈরাচারের অবস্থা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে," বলেছেন এইচআরডব্লিউ'র এশিয়া পরিচালক এলিন পিয়ার্স।
"অন্তবর্তী সরকারের উচিত টেকসই কাঠামোগত সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন তালিকাভুক্ত করা এবং অতীতের অপব্যবহার যেন কোনওভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নীলনকশা হয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা," যোগ করেন তিনি।
"অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করতে পারলে বহু প্রাণের বিনিময়ে কষ্টার্জিত এ অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে, একই সাথে ভবিষ্যতের সরকারকে যেকোনো দমন-পীড়নমূলক ভূমিকা নেবার পথ সহজ করে দিবে।”

“অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে মেরামত করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার আরও বলেছে যে তারা রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনগত পরিবর্তন আনবে, যা পরবর্তীতে নির্বাচিত সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হবে।”
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের আমলে বাকস্বাধীনতাকে দমন করতে নিবর্তনমূলক আইনটি করা হলেও অন্তবর্তী সরকার ওই আইনের পরিবর্তে একটি নতুন অধ্যাদেশ চালু করেছে। দুর্ভাগ্যবশত নতুন অধ্যাদেশে আগের আইনের মতোই অনেকগুলো ক্ষতিকারক ধারা-উপধারা রাখা হয়েছে।"
“ছাত্র নেতৃত্ব ও কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা বেষ্টিত। অনেকেই উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে বলেছে যে সংস্কারের গতি দৃশ্যমানভাবে কমে গেছে।”
"ইউনূস তার প্রশাসনের বাকস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। ”
“নভেম্বর পর্যন্ত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অভিযোগে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এছাড়া সরকারি দপ্তরগুলোতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ১৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। এছাড়া জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছে,” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
`` সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল"
শেখ হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থানে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংস আক্রমণকে ``নজিরবিহীন’’ বলে প্রতিবেদনে গা শিউরে ওঠা কিছু বর্ণনাও তুলে ধরা হয়েছে।
“হাসিনা সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে নির্বিচারে জনতার ওপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট এবং তাজা বুলেট ব্যবহার করেছিল। সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল।"
একজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, "আমি পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে গুলি চালাতে দেখেছি... অনেক ক্ষেত্রে, অফিসারদের জীবন বিপদে না থাকলেও আমি সরাসরি গুলি চালাতে দেখেছি।"

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বর্ণনা করেছেন যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দেন, যেন তারা ভিডিও গেমে কাউকে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।"
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “ভয় তৈরি করার উদ্দেশ্যে পুলিশ বিভিন্ন মানুষজনকে বাড়ির জানালায় অবস্থানের সময়ও গুলি চালায়।”
পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের জন্য স্পষ্ট এবং অন্তর্নিহিত উভয় নির্দেশ পেয়েছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কঠোর হতে এবং 'অরাজকতা' ছড়ানো কোনও অপরাধীকে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে “গুলি কর" শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল; সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন, কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুন।”
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে।
যা বললেন প্রেস সচিব
অন্তবর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “আমরা এইচআরডব্লিউ'র প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাই। "
প্রতিবেদনে বিগত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন-নিপীড়নের বর্ণনা বিশদভাবে উঠে এসেছে।
“তবে প্রতিবেদনে অন্তবর্তী সরকারের সময় পুলিশের ভূমিকার অংশে তথ্যগত ঘাটতি আছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারগুলোর সদস্যরাই বেশিরভাগ মামলা করছে, ইউনূস সরকার বা পুলিশ কোন মামলা করছে না। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অসংখ্য আসামি করে মামলা দায়ের করছেন, পুলিশকে এক ধরনের বাধ্য করছেন। তবে আমরা পুলিশকে প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে দেখতে বলেছি। কোন ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা হয়ে থাকলে সেগুলো ড্রপ করতেও বলা হয়েছে।"
শফিকুল আলম আরো বলেন, অন্তবর্তী সরকারের হাতে সংস্কারের জন্য এক বছরেরও কম সময় থাকলেও সংস্কার টেকসই হবে। "ইমপ্যাক্টফুল রিফর্মের জন্য জুলাই চার্টারের উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে আনা হবে এবং দলগুলো এই চার্টারে সই করবে, যাতে করে অন্তবর্তী সরকারের হাতে কম সময় থাকলেও পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সংস্কারের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।"
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, "আইনজীবী হওয়ার কারণে ক্রমাগত বিভিন্ন ভুক্তভোগী মানুষদের কথা শোনার সুযোগ হয়েছে। আমার কাজের অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশ খুব ভয়ঙ্করভাবে তার পুরনো রূপে ফিরে এসেছে। নির্বিচারে এসব মামলার ঘটনায়, পুলিশ নিজের স্বার্থ বা নিজের লাভের কারণে হোক, তারা বিএনপি কিংবা জামায়াতের আশ্রয়ে এসবে করছে। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে রাজনৈতিক দলে ভিড়ে যাচ্ছে। আমি এইচআরডব্লিউ'র প্রতিবেদনের সাথে একমত পোষন করি। একই সাথে মনে করি, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশ বাহিনীর রাশ টানা না গেলে আমাদের (বাংলাদেশিদের) কপালে দুঃখ আছে।"
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বেনারকে বলেন, এইচআরডব্লিউ পুলিশের পুরনো রূপে ফেরার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা আমরাও গত কয়েক মাসে বিভিন্ন ফোরামে বলে আসছি, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে জানিয়েছি। "গণহারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে ঢালাও অভিযোগে শত শত মামলার পেছনে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা রয়েছেন। আসছে নির্বাচনে তাদের সম্ভাবনা বেশি থাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও অনেকের নাম মামলায় দেয়া হচ্ছে। তবে, বিভিন্ন দপ্তরে জানানোর পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। হাসিনা শাসনামলের মত একেবারে গণগেপ্তারের ঘটনা এখন ঘটছে না। নিরপরাধ কেউ গ্রেপ্তার হলেও আদালতগুলো অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে জামিন দিচ্ছেন।"