ইউপি নির্বাচন ঘিরে আগ্রহের পাশাপাশি উৎকন্ঠা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.21
160321-BD-bangladesh-post-620.jpg মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল সোমবার দেশের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে গেছে নির্বাচনী সরঞ্জাম। মার্চ ২০১৫।
ফোকাস বাংলা

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সব সময়ই বিশেষ আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে আগ্রহের পাশাপাশি জনমনে উৎকণ্ঠাই বেশি। কারণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে প্রায় সব ইউপিতে প্রতিপক্ষকে প্রার্থী হতে বাধা দেওয়া, সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলেছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে সক্রিয় ও সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে। দেশে এবারই প্রথম রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে এই নির্বাচন হচ্ছে।

আগামী জুন পর্যন্ত মোট ছয় ধাপে ৪ হাজার ২৭৫টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে মঙ্গলবার ৭১৯টিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে ১৫টির নির্বাচন হবে এ মাসের মধ্যে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দফার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গতকাল সোমবার পর্যন্ত সংঘটিত সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন প্রায় দুই হাজার মানুষ।

সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও দলটির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনা ঘটছে।

“দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়াটা বড় কথা নয়। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সবার কাম্য,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তবে তাঁর মতে, জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন এই নির্বাচনে হবে না।

প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৫৪টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষিত হতে যাচ্ছেন।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৩১, বিএনপি ৬১৩, জাতীয় সংসদে একই সঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে থাকা জাতীয় পার্টি ১২৭, জাসদ ২৯, বিকল্পধারা ৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৩, জাতীয় পার্টি-জেপি ১৭, বিএনএফ ৭, সিপিবি ৪, তরিকত ফেডারেশন ১, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ১, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ২২৭ ও ন্যাপ ৩টি ইউপিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে।

সোমবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছে, ৭৩২টি ইউপির ভোটার সংখ্যা ১ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৭৪১। ভোট কেন্দ্র ৬ হাজার ৯৮৭টি। চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩ হাজার ৪৩ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে প্রার্থী ৭ হাজার ৫৭৫ জন ও সাধারণ সদস্য পদে প্রার্থী ২৫ হাজার ৮৪৭ জন।

ইতিমধ্যে সাধারণ সদস্য পদে ১৭৯ জন এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত সদস্য পদে ৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে আছেন।

অস্বস্তিতে সরকারের শরিকেরা

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বিভিন্ন দল মাঠ পর্যায়ে অস্বস্তিতে পড়েছে। ১৪ দলের যেসব প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তারা হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্যে আছেন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ১৪ দলের অন্যান্য প্রার্থীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।

“সরকারি দল আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা তাৎক্ষণিক লাভের আশায় দূরের ভালোকে অবজ্ঞা করছে। ১৪ দলের ঐক্য এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে,” জানান ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।

তৃণমূলে গণতন্ত্র চর্চা বাড়াতে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১৪ দলের শরিক সংগঠনগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মত দেয় যে, এর ফলে তৃণমূলে ওই সব সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার হবে।

“মাঠপর্যায়ে গায়ের জোর বিবেচনায় ১৪ দলের শরিক দলের প্রার্থীরা দুর্বল। তাই আমাদের প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় সরকারি দলের প্রভাবশালীদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনও যুক্ত হচ্ছে। এটা বিব্রতকর ও দুঃখজনক,” বেনারকে জানান সাতক্ষীরা-১ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ মুস্তফা লুৎ​ফুল্লাহ।

তিনি বলেন, ১৪ দল বা মহাজোটের প্রার্থী যাঁরা মনোনীত করেছেন তাঁরা এই সরকারেরই মন্ত্রী বা সাংসদ। নিজের এলাকায় তাঁদেরও যথেষ্ট প্রভাব ও পরিচিতি রয়েছে। সরকারি দলের প্রভাবশালীরা ওই সব এলাকায়ও ছাড় দিতে চাইছে না।

নির্বাচনের নামে তামাশা: বিএনপি

মনোনয়ন জমা দেওয়ার শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভয়ভীতি, হুমকি ও মারধরের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

“এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে জবরদস্তিমূলক, ন্যক্কারজনক ও তামাশার নির্বাচন। হামলা-মামলা, ভয়ভীতি ও কারচুপির প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার পর এটা হবে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন,” বেনারকে জানান দলের যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান।

নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন নির্বাচনে সরকারি দলকে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ তোলেন ওই নেতা।

“বিরোধী দল সব সময় এমন অভিযোগ করে। তবে তারা যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এটা ভালো সিদ্ধান্ত,” বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের, যিনি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী।

ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী পুলিশের মহাপরিদর্শককে বলেছেন, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। পুলিশ ও প্রশাসন যেন নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে।

নির্বাচন অর্থ​কেন্দ্রিক হয়ে গেছে: সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারের অন্যান্য বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ওপর কমিশনের কর্তৃত্বও কম। যে কারণে কমিশন এসব বিভাগের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পায় না।

সোমবার কমিশনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সিইসি এ কথা বলেন।

নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া, হানাহানি, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি বিষয়ে কাজী রকিব উদ্দীন বলেন, সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সব কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাওয়া যায় না বলেই নির্বাচনী সহিংসতা হয়।

সিইসি আরও বলেন, দুঃখজনক হলো এ দেশের নির্বাচন আগে থেকে মারপিট ও খুনখারাবির চিত্র বহন করে আসছে। নির্বাচন অর্থকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যার শক্তি বেশি সে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী মনে করে। যে কারণে হানাহানি ও সহিংসতা থামছে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রস্তুতি

নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা-সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে তিনজন পুলিশ ও আনসার মিলিয়ে মোট ২০ সদস্যের বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। এঁদের মধ্যে অস্ত্রসহ থাকবেন সাতজন। তবে প্রয়োজনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়াতে পারবেন।

এর বাইরে প্রতিটি ইউনিয়নে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও আনসারের সমন্বয়ে গড়া একটি করে ভ্রাম্যমাণ দল এবং প্রতি তিন ইউনিয়নের জন্য একটি অপেক্ষমাণ বাহিনীর দল (স্ট্রাইকিং ফোর্স) দায়িত্ব পালন করবে।

প্রতিটি উপজেলায় থাকবে র‍্যাবের দুটি করে ভ্রাম্যমাণ দল ও একটি করে অপেক্ষমাণ দল এবং দুই প্লাটুন বিজিবি ভ্রাম্যমাণ ও এক প্লাটুন অপেক্ষমাণ বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য প্রতিটি উপজেলায় একজন করে বিচারিক হাকিম এবং নির্বাচনী অপরাধ আমলে নিয়ে জরিমানা আদায়ের জন্য পাঁচজন করে নির্বাহী হাকিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ভোট গ্রহণের আগের তিন দিন থেকে পরের তিন দিন পর্যন্ত, মোট সাত দিন বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ক্যাম্প করতে পারবেন না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।