ইসলামপন্থী পরিচয়ে একের পর এক বাউল অনুষ্ঠান পণ্ড
2024.12.30
ঢাকা
বাউল শিল্পীদের সংগঠন অভিযোগ করেছে যে, উগ্রপন্থীদের হামলা ও হুমকির মুখে গত আড়াই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে একের পর বাউল গানের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে। বাউল শিল্পীরা বলছেন, অতীতে মাঝেমধ্যে কিছু অনুষ্ঠান বাতিল হলেও পরপর এতো অনুষ্ঠান পণ্ড করার ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
“অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের সংগঠনের হিসেবে দেশে ৩২১ টি বাউল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে ঢাকা বিভাগে; ৯১ টি,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সরদার হীরক রাজা।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহে ৩৪, খুলনায় ৩৯, রংপুরে ৩৩, চট্টগ্রামে ৩৭, রাজশাহীতে ৩৩, বরিশালে ১৭ এবং সিলেটে ৩৭টি বাউল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।
বেনার নিউজের পক্ষ থেকে এসব সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
তবে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
“আমাদের সংগঠনের বাইরে আরও কয়েকটি বাউল সংগঠন রয়েছে, তাদের কিছু অনুষ্ঠান বন্ধ হলেও সেগুলোর সঠিক সংখ্যা জানা নেই,” যোগ করেন সরদার হীরক রাজা।
এবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতেও বাউল অনুষ্ঠান তুলনামুলক কম হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে কয়েকটা অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে দর্শকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। তার মানে মানুষ বাউল সঙ্গীত পছন্দ করে, কিন্তু নানামুখি বাধার কারণে আমরা তাদের গান শোনাতে পারছি না।
উল্লেখ্য, বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের একটি অনন্য ধারা বাউল গান।
কুষ্টিয়া লালন একাডেমির শিল্পী শিরিন সুলতানা বেনারকে বলেন, “গত আড়াই মাসে আমাদের দলেরই অন্তত ২০টি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে।”
নিজেদের কণ্ঠশ্রমিক পরিচয় দিয়ে শিরিন বলেন, “এই মৌসুমে যা উপার্জন করি তা দিয়ে প্রায় সারাবছর চলতে হয়। কিন্তু এভাবে একের পর এক অনুষ্ঠান বাতিল হতে থাকলে বাউলরা না খেয়ে মরবে।”
এর আগে গত ২২ ও ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে লালন মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও হেফাজতে ইসলাম ও স্থানীয় মুসল্লিদের আপত্তির মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়।
তবে আগামী ১-৩ জানুয়ারি আবারও এই অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহজালাল।
তিনি বেনারকে বলেন, “নিজের সম্পত্তিতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আমি অনুষ্ঠান করি। এবার অনুষ্ঠানের সপ্তাহখানেক আগে গত ১৫ নভেম্বর কিছু উগ্রবাদী লোক এসে সঙ্গীত অনুষ্ঠান আয়োজন না করার হুমকি দেয়। আমাকে নাস্তিক বলে গালাগাল করতে থাকে।”
ফকির শাহজালাল বলেন, “আমি বলেছি আমি সাইজিকে (লালন) ভালোবাসি। অন্যায় কিছু করিনি। তারপরও তারা মঞ্চ ভেঙে আমাদের অনুষ্ঠানস্থল থেকে তাড়িয়ে দেয়, এমনকি খাবার জন্য সময়টুকুও দেয়নি।”
জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেও সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
ফকির শাহজালাল বলেন, “আগামী ১-৩ জানুয়ারি আমরা আবারও সাধুসঙ্গ আয়োজন করেছি। এবার বিপত্তি ঘটলে আমরা রাস্তায় নামব।”
তবে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বেনারকে বলেন, “আবেদন পেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
অভিযোগ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে
গত ২ ডিসেম্বর গাজীপুরের মাওনা এলাকায় অনুষ্ঠানের বন্ধের উদাহরণ টেনে বাউল শিরিন সুলতানা বলেন, “অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমরা রেডি। তখনই খবর পাই কিছু মৌলবাদী লোকজন অনুষ্ঠানের মঞ্চ ও শিল্পীদের যন্ত্র ভেঙে দিচ্ছে।”
জানতে চাইলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার জাহিদুল হাসান বেনারকে বলেন, এ ধরনের কোনো হামলার কথা তারা জানেন না।
এর আগে গত ২৩ নভেম্বর শরীয়তপুরে জাজিরার হযরত দয়াল বাবা গণি শাহ রঃ এর রুহানি দরবার শরীফে আরো একটি বাউল অনুষ্ঠান বাতিল হয় বলেও জানান শিরিন সুলতানা।
ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির প্রধান সায়েম আহমেদ রনি বেনারকে বলেন, প্রশাসনের অনুমতিতে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও প্রথম দিনেই স্থানীয় জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা এসে অনুষ্ঠান বন্ধের হুমকি দেয়। পরে কিছুটা সময় বাউল গান করে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিই।”
গত ১০ বছর যাবত অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রথমবার এমন বাধার মুখে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, থানায় জানালেও তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে চায়নি। বলেছে নিজেরা প্রতিরোধ করতে পারলে অনুষ্ঠান করেন। আমরা ঝুঁকির কথা ভেবে অনুষ্ঠান বন্ধ করে বাউলদের ফেরত পাঠাই।”
অভিযোগ অস্বীকার করে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন বেনারকে বলেন, এ ধরনের (বাউল) অনুষ্ঠান আয়োজন করে তারা ভুল করেছেন বুঝতে পেরে আয়োজকরা নিজেরাই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়।
শৈশব থেকে গান গাওয়া শিরিন বলেন, “গত বছরও এই মৌসুমে প্রতিদিনই আমার গানের অনুষ্ঠান ছিল। এবার একের পর এক বাতিলই হচ্ছে।”
এসব অনুষ্ঠান বন্ধের পেছনে জড়িতের সম্পর্কে জানতে চাইলে বাউল হীরক রাজা বলেন, “কিছু মানুষ না বুঝে সংস্কৃতিকে ধর্মের জন্য ক্ষতিকর মনে করে।”
“আমরা বিশেষ কারো নাম বলতে চাই না। তবে সরকার বা পুলিশের দায়িত্ব এদের খুজে বের করা এবং বাউল উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করা,” বলেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের লালন উৎসব বন্ধের জন্য হেফাজত ইসলামের দাবি ছিল উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় মুসল্লীদের বাধার মুখে সেখানকার অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছিল।
ওই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও স্বীকার করেন জেলা প্রশাসক।
জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের মুখপাত্র মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বেনারকে বলেন, “এ ধরনের সঙ্গীত চর্চা শরিয়তের পরিপন্থী। যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন মুসলমান পরিচয়ে যদি এমন গানবাজনা করে, যা কুরআন-সুন্নাহ ও শরিয়ত বিরোধী; তাহলে সেটা শুধু হেফাজতে ইসলাম নয় যেকোনো মুসলমান সমর্থন করতে পারে না। আমাদের দাবি, এসব বাউল সংগঠন যেসব ইসলামবিরোধী অনুষ্ঠান করছে, সরকার সেগুলো যেনো আইনের মাধ্যমে বন্ধ করে।”
বিভিন্ন স্থানে বাউলদের ওপর হামলা ও বাউল অনুষ্ঠান বন্ধে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইসলামপন্থী এই নেতা বলেন, “কোথাও হামলা, মারধরের ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে, হেফাজতে ইসলাম এই দায় নেবে না। আমরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারি না।”
উদীচীর সাবেক সভাপতি মাহমুদ সেলিম বেনারকে বলেন, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বাউল উৎসবের মতো মুক্তচিন্তার অনুষ্ঠানের উপর হামলা বেড়েছে বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর আগেও ইসলামিস্টরা এ ধরনের অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করত। তবে তখনকার সরকারকে তারা ভয় পেতো। বর্তমান সরকারের সময়ে তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করছে।
“বাউল গান বাংলা সংস্কৃতি ও নব্য সুফিবাদের অংশ। ইসলামী তরিকায় ধ্যান, জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার কথা বলা আছে। এটাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান।
প্রবীণ বাউল শিল্পী হাদি খ্যাপা বেনারকে বলেন, “প্রশাসনের কাছে প্রতিকার না পেলে প্রয়োজনে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”
যা বললেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা
এ বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বেনারকে বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেনি সেটা বলব না। তবে সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে।
“বাংলাদেশে এ ধরনের যাত্রা গান, পালা গান, বয়াতি বাউল অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ নয়। বরং এসব অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার পক্ষে সরকার। এটাই আমাদের ফিলোসফি। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে দেশজুড়ে বাউল অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে,” বলেন মোস্তফা সরয়ার।
৩২১ টি অনুষ্ঠান বাতিলের বিষয়ে তিনি এসব ঘটনা প্রতিটি সত্য কিনা- তা তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করেন।
বাউল বা এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজকদের উদ্দেশ্যে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, তারা যদি কোনো বাধার মুখে পড়েন তাহলে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনকে জানাবেন, তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
দেশের যেকোনো নাগরিকের ওপর হামলা অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক বেনারকে বলেন, বাউলদের উপর হামলার ঘটনায় কিছু মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জিয়া চৌধুরী ।