শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় শিক্ষার্থীরা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.09.12
ঢাকা
শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় শিক্ষার্থীরা রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় রোববার গাড়ির ধাক্কায় তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র আলী হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত চালককে গ্রেপ্তারের দাবিতে সোমবার ফার্মগেট ও বিজয় সরণি এলাকায় সড়ক অবরোধ করে নিহতের সহপাঠীদের বিক্ষোভ। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

সড়ক দুর্ঘটনায় দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোমবার রাস্তায় নেমেছিলেন রাজধানীর তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ ছাত্রছাত্রী। ঢাকার ব্যস্ততম ফার্মগেট ও বিজয় সরণি এলাকায় তাঁরা অবস্থান নেওয়ায় শহরের বড়ো এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় যানজট।

পুলিশের পক্ষ থেকে ছাত্রদের বিক্ষোভ কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। তবে পুলিশদের অনুরোধে কয়েক ঘণ্টা পর বিক্ষোভে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিয়ে যান শিক্ষকরা।

রোববার সকাল সোয়া সাতটায় সরকারি বিজ্ঞান বিদ্যালয় শাখার দশম শ্রেণির ছাত্র আলী হোসেনকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায় একটি মাইক্রোবাস। মাথায় আঘাত পেয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

একদিন আগে নিহত আলী হোসেনের এই মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ শ্লোগান দিতে দিতে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ফার্মগেটের আল-রাজী হাসপাতালের সামনে মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন সরকারি বিজ্ঞান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গভর্নমেন্ট সায়েন্স স্কুল ও তেজগাঁও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। শিক্ষকদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের রাস্তা থেকে সরে যেতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেও প্রথম দফায় কাজ হয়নি। এরপর শুরু হয় বৃষ্টি এবং বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা মিছিল নিয়ে বিজয় সরণি মোড়ে প্রায় ১০ মিনিট অবস্থান করেন।

সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ মো. আইয়ুব ভূঁইয়া সোমবার বেনারকে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় আলী হোসেন নিহত হওয়ার প্রতিবাদ করতে আমাদের ছাত্ররা সকাল থেকে একত্রিত হয়। বর্তমানে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সেকারণেই তারা খুব সহজেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পেরেছে।”

তিনি বলেন, “আমি এবং অন্য শিক্ষকরা এসে ছাত্রদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেই। শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে বেলা দেড়টার দিকে ওই সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।”

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বাসের চাপায় প্রাণ হারান ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী।

এই ঘটনার প্রতিবাদ ও হত্যার বিচার চেয়ে ওই দিন প্রথমে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” শ্লোগান দিয়ে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেন।

পরদিন থেকে সেই আন্দোলন প্রথমে পুরো ঢাকা এবং পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভে যোগ দেন অভিভাবকরা। একটানা সাতদিন রাজধানী ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে আন্দোলনকারীরা।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাশ করে সরকার। এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে অভিযুক্তদের শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়।

তবে এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা। পরিবহন ধর্মঘট ও তীব্র বিরোধিতার কারণে মালিক-শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী সেই আইন পুরোপুরি কার্যকর করেনি সরকার।

একইসাথে এই আইনের সংশোধনী আনছে সরকার।

মাইক্রোবাসের চালক আটক

আলী হোসেনকে ধাক্কা দেয়া মাইক্রোবাসের চালককে আটক করা হয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার সময় সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় মাইক্রোবাসটিকে শনাক্ত করা হয়।

সোমবার সকালে আশুলিয়ার বিশ মাইল এলাকা থেকে চালক জিয়াউল হককে (৫০) আটক করা হয় বলে জানান আজিমুল হক। মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

সড়কের নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, সড়কে নৈরাজ্য চলছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বন্ধ করতে হবে। যার সন্তান চলে যায় তিনিই এই ব্যথা বোঝেন।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আইন আছে, প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে। কিন্তু তাহলে আইনের সঠিক এবং কঠোর বাস্তবায়ন হবে না কেন? বিচারের জন্য কেন বার বার আমাদের বাচ্চারা রাস্তায় নামবে? আবার কেনই বা একটি প্রাণ এভাবে ঝরে যাবে।”

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির অন্যতম কারণ হলো, পার পেয়ে যাওয়া। সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলো এমন করে সাজানো হয় যাতে বিচার ব্যবস্থাও অসহায় হয়ে পড়ে। বিচার সঠিকভাবে হয় না। সুতরাং, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, এই পার পেয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, কোন একটি ঘটনা ঘটার পর চারিদিকে হইচই লেগে যায়। কিছুদিন পর সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, মিডিয়া, সুশীল সমাজ সবাই সেগুলো ভুলে যায়। এভাবে ঘটনা চাপা পড়ে যায়।”

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু সমস্যা রয়েছে তৃণমূলে আইন বাস্তবায়নে।”

তিনি বলেন, “২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন পাশ করে। কিন্তু সেই আইন এখনও সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। কারণ, পরিবহন মালিকদের হাত অনেক লম্বা।”

“সড়কে প্রাণহানির জন্য গাড়িচালক ছাড়াও গাড়ির মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে,” বলেন রাশেদা কে. চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।