পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের জলসায় হামলা, নিহত ১
2023.03.03
ঢাকা
দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিমদের বার্ষিক জলসাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের মতো পুলিশের সাথে স্থানীয় মুসল্লিদের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন আহমদিয়া মুসলিম জামাতের মিডিয়া মুখপাত্র তাবসির আহমদ চৌধুরী।
২০১৯ সালের পর পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর এটি প্রথম আক্রমণ।
স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মুসল্লিদের সাথে পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল।
পঞ্চগড় শহরের বাসিন্দা তানভীর জামান তনু বেনারকে বলেন, নিহত ব্যক্তির নাম আরিফ (২২)। তিনি শহরের মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তাঁর বাবা স্থানীয়ভাবে ফরমান নামে পরিচিত।
আহত হওয়ার পর তনু ও তাঁর বন্ধুরা আরিফকে প্রথমে পঞ্চগড় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার ডাক্তাররা মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।
তনু বলেন, “আমি এবং আমার বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আরিফের মাথায় মারাত্মক জখম ছিল।”
তিনি বলেন, “পঞ্চগড় শহর থেকে রংপুর প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। পথিমধ্যে আমরা একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করে জানতে পারি আরিফ মারা গেছেন। এখন আমরা পঞ্চগড়ে ফিরে যাচ্ছি।”
পুলিশের পক্ষ থেকে ওই সময় পর্যন্ত মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি আহত ব্যক্তিদের সংখ্যার ব্যাপারেও কিছু জানানো হয়নি। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘর্ষে আহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা রহিমুল ইসলাম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় আহত ১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, ২৭ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ঘটনায় আহতদের কেউ অন্যত্র চিকিৎসা নিয়ে থাকলে তা তার জানা নেই।
কীভাবে মারা গেলেন আরিফ?
পঞ্চগড় গার্লস স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও আরিফের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর আলম বেনারকে বলেন, “ঘটনা বেলা দুইটার পর, ডোকরো এলাকায় পঞ্চগড় শহর বাইপাসের কাছে। বাসার জানালা দিয়ে আমি পুরো ঘটনা দেখেছি।”
তিনি বলেন, “রাস্তার ওপর একদিকে কিছু যুবক একত্রিত হয়েছিল। আর বিপরীত দিকে দাঙ্গা পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল। মাঝে মাঝে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করছিল।”
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমি দেখলাম একজন যুবক হঠাৎ লুটিয়ে পড়ল। সবাই তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। পরে জানলাম লুটিয়ে পড়া যুবক আরিফ।”
তিনি বলেন, “আরিফের পরিবার দিন আনে দিন খায়। ওরা দুই ভাই-বোন। ওর বাবা পুরানো কাপড়ের ছোট একটি দোকান চালায়। স্নাতক পাশ করে চাকরি না পেয়ে একটি প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার হিসাবে কাজ করত আরিফ।”
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “উনারা আমার শ্বশুড়বাড়িতে ভাড়া থাকেন। প্রতিমাসে ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারেন না। কিছু ঋণ করেছেন। আরিফের মৃত্যুতে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেলো।”
যেভাবে শুরু
পঞ্চগড় জেলার আহম্মদনগর ও পাশের সালসেরি গ্রামে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।
শুক্রবার থেকে সেখানে তিন দিনব্যাপী সালানা জলসা শুরু হয়। এই জলসা বন্ধ করতে গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা মাশায়েক আইম্মা পরিষদের ব্যানারে শত শত লোক মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
বিক্ষোভকারীরা বাঁশ ফেলে শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কগুলো বন্ধ করে দেন, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন।
বৃহস্পতিবারের জের ধরে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মুসল্লিরা চৌরঙ্গী মোড়ে জড়ো হয়ে মিছিল বের করেন।
ওই মিছিল থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন মুসল্লিরা। পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন।
ক্ষুব্ধ মুসল্লিরা ধাক্কামারা এলাকার ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয় আগুন ধরিয়ে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আক্রমণকারীরা শহরের কেউ না, বহিরাগত। আমরা তাদের চিনি না।”
অবহেলার অভিযোগ
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের মুখপাত্র আহমদ তাবসির চৌধুরী বেনারকে বলেন, শুক্রবার থেকে তিনদিনব্যাপী বার্ষিক জলসা শুরু হয়েছে। জুম্মার পর আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। একজন মারা গেছেন। আরও তিনজনের অবস্থা গুরুতর।”
তিনি বলেন, “আমাদের অনেক বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়েছে। পুরো ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনও করা হয়নি।”
তাবসির চৌধুরী বলেন, “আমি মনে করি, পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। আমরা তাদের বার বার জানিয়েছি, আমাদের গ্রাম দুটিতে পুলিশ মোতায়েন করতে। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা শুধু বলছিল, তারা শহরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “এই আক্রমণের পরে আমাদের অনুষ্ঠান চলবে কি না সেব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।”
পঞ্চগড় জেলার পুলিশ সুপার এস. এম. সিরাজুল হুদা বেনারকে বলেন, হাজার হাজার মুসল্লি আহমদিয়াদের আক্রমণ করেছে।
তিনি বলেন, “আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। আমাদের দিক থেকে কোনো অবহেলা নেই। আমরা সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবরকম চেষ্টা করছি।”
স্বার্থের দ্বন্দ্ব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক আবু খালেদ মোহাম্মদ খাদেমুল হক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে আহমদিয়া মুসলিমরা প্রায় প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হন।
তিনি বলেন, “আহমদিয়াদের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপগুলো তাঁদের মুসলিম বলে স্বীকার করতে চান না। উনাদের যুক্তি, কাদিয়ানিরা তাদের ধর্মীয় গুরু মির্জা গোলাম আহমাদকে নবীর সমতুল্য মনে করেন। যদিও কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়।”
অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “সেকারণে মাঝে মধ্যেই আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ।”
তিনি বলেন, “তবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি যৌক্তিক নয়। কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, কোনো মানুষের বিশ্বাস নিয়ে কোনো মানুষ প্রশ্ন করতে পারবে না। তাই, আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার এখতিয়ার কারও নেই।”
অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “সরকার যদি তাঁদের অমুসলিম ঘোষণা করে তখন দেখা যাবে কিছুদিন পর আরেক গ্রুপ প্রতিপক্ষকে অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলবে। এভাবে চলতে থাকবে।”
আহমদিয়াদের বিরোধিতার মূল কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এর পেছনে রয়েছে ইসলামকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। একটি ধর্মীয় ইস্যু সৃষ্টি করলে সহজেই মানুষকে নিজেদের দলে ভেড়ানো যায়। নিজেদের ক্ষমতা জাহির করা যায়।”
অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “সামনে নির্বাচন। এই সময়ে ইস্যু সৃষ্টি করে নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন আর্থিক ও রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করতেই আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণ হতে পারে।”