বায়ু দূষণ করছে পাঁচ লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, আইন প্রয়োগে অক্ষমতা

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.10.17
ঢাকা
বায়ু দূষণ করছে পাঁচ লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, আইন প্রয়োগে অক্ষমতা ঢাকার গাবতলী এলাকার রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। ২৭ জুন ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ কমপক্ষে পাঁচ লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন হলেও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে না পারায় সেগুলো রাস্তা থেকে সরানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান।

নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার এই তথ্য জানান বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান বিশ্বের অন্যান্য শহরের চেয়ে অনেক খারাপ, যার অন্যতম কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন।

মঙ্গলবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল শীর্ষে। সকাল পৌণে দশটায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ১৮৩ নিয়ে রাজধানীর বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ হয়ে পড়ে।

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা এবং ভারতের মুম্বাই ও কলকাতা যথাক্রমে ১৬৯, ১৬৬ এবং ১৬৫ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে ছিল।

সোমবারও সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে ১৯৪ একিউআই স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে।

কোনো এলাকার একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ এর মধ্যে থাকলে তাকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর' এবং ৩০১ থেকে ৪০০ স্কোরকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট সংকট

দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে ঢাকা। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়।

ঢাকার বায়ু দূষণের চিহ্নিত তিনটি প্রধান উৎস ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো।

বিভিন্ন বয়সের মানুষ শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভোগার অন্যতম কারণও এই বায়ু দূষণ।

২০১৯ সালে সম্পন্ন করা বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৯০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, যা প্রতিরোধযোগ্য।

বিআরটিএর আইন প্রয়োগে “দুর্বলতা” আছে মন্তব্য করে চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, “কারণ বিআরটিএর পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট নেই।”

তিনি বলেন, কেবল রাজধানী ঢাকায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং ফিটনেস পরীক্ষার জন্য অন্তত ১০০ ম্যাজিস্ট্রেট দরকার। কিন্তু এর বিপরীতে রয়েছে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জন।

অনুপযোগী, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের কারণে বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ, ও দুর্ঘটনা ঘটে জানিয়ে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এগুলোর সবই সরাসরি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”

“কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এগুলো যেন দেখার কেউ নেই। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এগুলো সরকারের প্রাধান্যের মধ্যে নেই,” বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “চেয়ারম্যান বলছেন, ১০০ জনের বিপরীতে বিআরটিএ’র রয়েছে মাত্র ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট। এটা কীভাবে সম্ভব? তাঁরা কি বিষয়টি নিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন? সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।”

তাঁর মতে, বিআরটিএ হয়তো “পরিবেশ আইনগুলো সঠিক ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেনি। কারণ পুরো পরিবহন ব্যবস্থা ক্ষমতাবানদের হাতে। এই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে হয়তো ব্যবস্থা নিতে চায় না কর্তৃপক্ষ!”

“উনারা চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আমি আশা করি উনারা চেষ্টা করবেন,” বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

20231016124634_SONY0883-01.jpeg
ঢাকার দয়াগঞ্জ এলাকায় ধুলায় ঢেকে যাওয়া রাস্তায় রিকশায় করে যাচ্ছেন দুজন যাত্রী। ১৬ অক্টোবর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি

২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী ইটভাটা ও বায়োমাস পোড়ানো বায়ু দূষণের মূল কারণ। এরপর রয়েছে পরিবহন খাত।

বিআরটিএ’র হিসাবে দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৫৯ লাখ যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ২০ লাখের বেশি যানবাহন।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন হরহামেশা চোখে পড়লেও এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুপযুক্ত যানবাহন বায়ু দূষণের প্রধান কারণ না হলেও “অন্যতম কারণ” জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ) জিয়াউল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ঢাকা শহরে যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণ করে।”

তিনি বলেন, চলাচলের অনুযোগী যানবাহন বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তর বহু বছর ধরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু রাস্তা থেকে অনুপযোগী যানবাহন সরছে না।

বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২২ অনুযায়ী সকল মোটরযানের নিঃসরণ মাত্রা কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং ক্ষুদ্র বস্তুকণা—এই তিন পরিমাপে হিসাব করা হয় বলে জানান জিয়াউল হক।

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ডিজেল চালিত একটি যাত্রীবাহী গাড়ি প্রতি কিলোমিটারে সর্বোচ্চ এক গ্রাম কার্বন মনোক্সাইড, শূন্য দশমিক সাত গ্রাম হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং শূন্য দশমিক আট গ্রাম বস্তুকণা নিঃসরণ করতে পারবে। এর বেশি হলে সেটি বায়ু দূষণ করবে।

“কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ যানবাহন নির্ধারিত মাত্রার মধ্যে থাকে থাকে না,” বলেন তিনি।

বিভিন্ন সময় তাঁরা মোবাইল কোর্টসহ বায়ু দূষণ বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দূষণ মাত্রা নির্ধারণের জন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দরকার হয়। সেগুলোর সংখ্যা অপর্যাপ্ত।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।