ক্ষমতার পালাবদল: আধিপত্য নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে বেড়েছে সহিংসতা
2024.11.14
ঢাকা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ঢাকার মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের সহিংসতার ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েছেন শরণার্থী, স্থানীয় বাসিন্দা এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী টানা অভিযান পরিচালনা করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের হিসাবে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রতিপক্ষের হামলায় এই ক্যাম্পে কমপক্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন। শরণার্থী শিবির সংলগ্ন ঢাকার বাসিন্দারা নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে সম্প্রতি কয়েক দফা মানববন্ধনও করেছেন।
পুলিশ ও ক্যাম্প নেতারা বলছেন, সরকার পতনের পর মাদক ব্যবসাসহ ক্যাম্পের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণকারী আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে গেলে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সেই শূন্যতা পূরণ করতে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।
“জেনেভা ক্যাম্প যেন ‘তুষের আগুন’। অভিযান জোরদার করায় সন্ত্রাসীরা কিছুটা চুপসে আছে, অভিযান শিথিল হলে তারা আবারও সহিংস হয়ে উঠবে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখার হাসান।
তাঁর মতে, কেবল অভিযান চালিয়ে এই পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান আসবে না, ওখানকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করতে হবে।
গত ৫ আগস্টের পর মাদক ব্যবসাসহ ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা ছাড়াও আশেপাশের এলাকার মানুষ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাসিন্দা নেসার উদ্দিন।
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু হলে পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি হয়। টহল কমলে আবারও অপরাধ শুরু হয়,” বলেন এই বেসরকারি কর্মকর্তা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য মোহাম্মদপুর এলাকায় স্থানীয়রা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
মোহাম্মদপুর কমিউনিটি অ্যাল্যায়েন্সের সদস্য পারভেজ হাসান সুমন বেনারকে বলেন, “আমরা মানববন্ধন করে পুলিশকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলাম।”
জেনেভা ক্যাম্পে গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সহিংসতা চলছে জানিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. তালেবুর রহমান বেনারকে বলেন, “মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধীরা এর সাথে জড়িত।”
“পুলিশ তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এ পর্যন্ত শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে,” বলেন তিনি।
কেন আলোচিত জেনেভা ক্যাম্প
জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করেন, যারা ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।
বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে আসা মুসলিম এই জনগোষ্ঠী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেন। সাধারণভাবে তাঁরা বিহারি হিসেবেও পরিচিত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বিভিন্ন এলাকায় ৬০টি ক্যাম্পে তাঁদের অস্থায়ীভাবে রাখা হয়। তাঁদের খাবারসহ মৌলিক বিষয়গুলো সরবরাহ করত রেডক্রস ও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, যা ১৯৮৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, প্রায় দেড় লাখ বিহারি পাকিস্তান চলে যান। বাংলাদেশে আটকা পড়েন এক লাখ ৪০ হাজার বিহারি। পরে পাকিস্তান আর কোনো বিহারিকে ফেরত নেয়নি। সে কারণে তাদের আটকে পড়া পাকিস্তানি বলা হয়।
২০০৮ সালে বিহারিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হলেও তাঁদের জেনেভা ক্যাম্প থেকে সরিয়ে পুনর্বাসন করা হয়নি।
এখানকার শিশুরা তেমন লেখাপড়া করে না। চুল কাটা, সবজি ও মাংস বিক্রি, রিকশা-ভ্যান চালানো, মোটর মেকানিক, গৃহপরিচারিকা শ্রমজীবী হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করে।
সবাই নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়
দারিদ্র ও অশিক্ষার কারণে জেনেভা ক্যাম্প সবসময়ই অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বলে বেনারকে জানান দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান।
তিনি বলেন, যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সবসময়ই এখানকার দরিদ্র মানুষগুলোকে মাদকসহ অবৈধ কাজে ব্যবহার করেছে।
“এই ক্যাম্পে প্রচুর টাকার মাদক ব্যবসা হয়। এর নিয়ন্ত্রণ সবাই নিতে চায়। সে কারণেই চলছে খুনোখুনি,” বলেন লতিফ খান।
তিনি বলেন, “জেনেভা ক্যাম্প থেকে মাদক নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। ঘরগুলো এতো ছোট এবং রাস্তাগুলো এতোটাই সরু যে, সেখানে অপারেশন চালানো খুবই কঠিন।”
বিহারিদের নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, “৫৩ বছর হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমাদের নেবে বলে প্রতারণা করেছে, নেয়নি। আবার বাংলাদেশও আমাদের পুনর্বাসন করেনি।”
জেনেভা ক্যাম্প নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গবেষণায় দেখা গেছে বয়স্ক বিহারিরা নিজেদের পাকিস্তানি বলতে ভালবাসলেও ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা নিজেদের বাসস্থান, জীবিকার জন্য নিজেদের বাংলাদেশি হিসাবে পরিচয় দিতে চায়।”
“কিন্তু তারা সবাই সাংস্কৃতিকভাবে পাকিস্তানকে ধারণ করে। যেমন তারা নিজেদের মধ্যে উর্দু ভাষায় কথা বলে, বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান তাদের মতো করে পালন করে,” বলেন তিনি।
মানবেতর জীবন যাপন
জেনেভা ক্যাম্পে সরেজমিন দেখা যায়, ছোট খুপড়ি ঘরে ৫-৭ জন করে মানুষ বাস করেন। এসব ঘরের আয়তন ৩০-৬০ বর্গফুট পর্যন্ত। তাঁদের বাসা ভাড়া এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল দিতে হয় না।
শিবিরের বাসিন্দা চাঁদনি বেগম (৩০) ৩০ বর্গফুটের একটি ঘরে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ঘরে দরজা-জানালা নেই। মাঝখানে একটি চৌকি পাতা। ঘরের সামনের অংশে একটি পর্দা টাঙ্গানো। রাত হলে পর্দা টেনে সবাই সেখানে ঘুমাই।
বিহারিদের নেতা নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, এমন অনেক পরিবার পাবেন বিছানার অভাবে যাদের মা-বাবা ও মেয়েরা রাতে ঘুমায় এবং ছেলেরা জেগে থাকে। তারা দিনে ঘুমায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিহারিদের নতুন প্রজন্ম তাদের বাংলাদেশি বলে পরিচয় দেয়। এই অবস্থায় এই ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়ে বিহারিদের বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিলে এই সমস্যার সমাধান হবে। পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের সমাজের মূল ধারায় তাঁদের সম্পৃক্ত করতে হবে।”