ভারত-মিয়ানমার দুর্গম সীমান্ত নজরদারিতে ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.04.19
ঢাকা
ভারত-মিয়ানমার দুর্গম সীমান্ত নজরদারিতে ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক
Photo: Benar

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে থাকা প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার সীমান্তের দুর্গম এলাকা দিয়ে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও মানবপাচার ঠেকানো এবং এলাকাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে বিদ্যমান সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটির কলেবর দ্বিগুণ করেছে সরকার।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০২০ সালে অনুমোদিত এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ (সংশোধন) প্রকল্পটির মেয়াদ, ব্যয় এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিধান রেখে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও উপসচিব শাহেদুর রহমান।

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের ভারতের সাথে ৩৩০ কিলোমিটার ও মিয়ানমারের সাথে ২১০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তের বেশিরভাগই দুর্গম।

অনুমোদিত প্রকল্প অনুযায়ী রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার দুর্গম সীমান্ত এলাকায় তৈরি এসব সড়কের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩১৭ কিলোমিটার।

চোরাচালান ঠেকানো ও নিরাপত্তার পাশাপাশি  পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতেও সড়কগুলো সহায়তা করবে বলে জানানো হয়েছে বেনারের হাতে আসা প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবনায়।

প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসে সমাপ্ত হবে। এর জন্য মোট খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৮৬১ কোটি টাকা।

২০২০ সালের প্রথম প্রস্তাবনায় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা, শেষ হবার কথা ছিল ২০২১ সালের জুনে।

নতুন প্রস্তাবনায় প্রকল্পের আওতায় সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ হেলিপ্যাড নির্মাণ এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনা  অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, তিন পার্বত্য জেলার সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজিবির জন্য সরকার রাশিয়া থেকে দুটি এম-আই সিরিজের হেলিকপ্টার ক্রয় করেছে।

বাস্তবায়ন করবে সেনাবাহিনী

সীমান্ত সড়ক নির্মাণের প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ.কে.এম. মনির হোসেন পাঠান।

ওইসব দুর্গম অঞ্চল সম্পর্কে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের চেয়ে সেনাবাহিনীর ধারণা বেশি থাকায় সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ধীর গতি হওয়ার মূল কারণ ওইসব সীমান্ত অঞ্চলের “দুর্গম ভূখণ্ড” জানিয়ে মনির হোসেন বলেন, “সেখানে নির্মাণসামগ্রী, যন্ত্রপাতি, যানবাহন, লোকবল সহজে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। সেকারণে প্রকল্পটির সময় তিন বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।”

সড়ক ও জনপথ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুসারে ২০২০ সাল থেকে এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩০ ভাগের কিছু বেশি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক “অত্যন্ত প্রয়োজন” উল্লেখ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক লেঃ কর্নেল ফয়জুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, দুর্গম ওই অঞ্চলে বিজিবি সদস্যদের দায়িত্ব পালন অনেক কষ্টের।

“এই এলাকায় কোনো সড়ক নেই; এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একটি সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে আরেক সীমান্ত ফাঁড়ির অবস্থান ভেদে দূরত্ব চার থেকে ছয় কিলোমিটার।”

কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ফাঁড়ি থেকে আরেক ফাঁড়িতে যেতে আট থেকে ১০ দিন পর্যন্ত লেগে যায় বলে জানান তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত রক্ষা অনেক কঠিন জানিয়ে ফয়জুর রহমান বলেন, “সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে আমাদের টহল জোরদার হবে এবং এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় খুব সহজেই আমাদের সদস্যরা পৌঁছাতে পারবে। ফলে অবৈধ অস্ত্র, মাদক চোরাচালান বন্ধ হবে।”

‘অপরাধ দমনে’ এই সড়ক খুব প্রয়োজন

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের উপস্থিতি সরকারিভাবে অস্বীকার করা হলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির উপস্থিতি নিয়ে প্রায়শই খবর প্রচারিত হয়।

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান আর্মির সদস্যরা বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা চালালে বিজিবির দুই সদস্য আহত হন।

তখনকার বিজিবি প্রধান জেনারেল আজিজ জানান, মিয়ানমারের ওই গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে বিজিবি। ওই ঘটনার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আরাকান আর্মির এক নেতাকে আটক করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই অঞ্চলের ভূখণ্ড খুবই দুর্গম। সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ কোনো বাহিনীর পক্ষেই সেখানে খুব সহজে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এই সুযোগে অপরাধী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো অনেকটা অবাধে তৎপরতা চালায়।”

তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি বাংলাদেশে চলাচল করে। আবার বাংলাদেশ বিরোধী গ্রুপগুলোও মিয়ানমার চলাচল করে থাকে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীগুলোর তৎপরতার সময় তারা অন্যদিকে চলে যায়।”

“সীমান্ত বরাবর যদি সড়ক নির্মাণ করা হয় তাহলে আমাদের বিজিবি খুব সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টহল দিতে পারবে। রাতে আলোর ব্যবস্থা থাকবে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধীদের চলাচল কমে যাবে, অপরাধ কমে যাবে,” বলেন মোহাম্মদ আলী।

তাঁর মতে, “ওই অঞ্চলে অপরাধ দমনে” এই সড়ক খুব প্রয়োজন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর চলাচল রয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে “দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের চলাচল অস্বাভাবিক নয়। আমরা আরাকান আর্মি, অথবা আরসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কথা শুনে থাকি,” জানিয়ে লে. কর্নেল ফয়জুর বলেন, “কিন্তু বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি আমরা পাইনি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।