পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরের জোট ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন শেখ হাসিনা
2023.08.18
ঢাকা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্যোগে ২০০৯ সালে গঠিত পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরের জোট ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে রোববার রাতে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে এ বছরের শেষে অথবা আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্য মত বিরোধের মধ্যেই শেখ হাসিনা ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট ২০২৩ জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হলো মার্কিন ডলার কেন্দ্রিক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার বিপরীতে একটি সাধারণ মুদ্রা চালু করা।
সরকার বলছে, ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক জোট। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ওই ফোরামের মাধ্যমে অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন সুবিধা মাথায় রেখেই ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায় বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ পশ্চিমাবিরোধী কোনো অবস্থান নিতে চায় না।
যদিও ব্রিকসের ব্যাপারে তেমন আশাবাদী নন সাবেক কূটনীতিকদের কেউ কেউ। তাঁদের ভাষায় ব্রিকসের মাধ্যমে আমেরিকার নেতৃত্বে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে ‘দল ভারী’ করার চেষ্টা করছে রাশিয়া ও চীন।
অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্রিকসে যোগদান
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে রোববার দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।”
“ব্রিকসের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি দেশকে সদস্য পদ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের একটি,” জানিয়ে ফারুক খান বলেন, “আমরা ব্রিকসের সদস্য পদ পাব কি না সেটি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু এই জোট আমাদের গুরুত্ব দিচ্ছে।”
“ব্রিকস সম্পূর্ণ একটি অর্থনৈতিক জোট। তারা আমাদের যে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি আমরা কাজে লাগাতে চাই,” যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে উন্নয়ন সহযোগিতা গ্রহণ করছি। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছ থেকে সহায়তা নিচ্ছি। ব্রিকস আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার একটি নতুন উৎস হতে পারে। আমরা ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চাই।”
“তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাই। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো এবং একইসঙ্গে সেটিও আমরা বজায় রাখতে চাই,” বলেন ফারুক খান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম. মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে ব্রিকসের আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্য হয়। ব্রিকসের সদস্য পদের জন্যও আবেদন করেছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুসারে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছিদ্রযুক্ত গ্যাস পাইপলাইন প্রতিস্থাপন ও মেরামত প্রকল্পের জন্য ৪৪২ মিলিয়ন ডলার এবং ওয়াসাকে পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য ২৩৫ মার্কিন ডলার দেবে এনডিবি।
পশ্চিমাদের সঙ্গে মতবিরোধ
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ চলছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন সরকার।
২০২৩ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করতে পারেন এমন ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর দু’দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়।
প্রধান বিরোধীদল বিএনপি মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও প্রকাশ্যে আমেরিকার সমালোচনা করেছেন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা।
বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়।
এক জনসভায় তিনি বলেন, আমেরিকায় না গেলে কিছু হবে না। বিশ্বের অনেক দেশ, মহাদেশ, মহাসাগর রয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে।
ব্রিকসের ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সেটি আমাদের জন্য ভালো। এই জোটের সদস্য রাষ্ট্র যেমন ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সুন্দর দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “ব্রিকস মূলত পূর্বমুখী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছে। ভবিষ্যতের ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত দুই কারণেই এই জোটের সদস্য হওয়া অথবা সংশ্লিষ্ট থাকা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক।”
বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য কমানো এবং একটি নতুন সাধারণ মুদ্রা চালু করার ব্যাপারে এবারের ব্রিকস সম্মেলনে আলোচনা হওয়ার কথা বলে জানান তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক জোট। এনডিবি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা ও উন্নয়ন সহায়তা পেতে পারে বাংলাদেশ। এখানে গেলে পশ্চিমারা যে এটি খারাপভাবে নেবে কথাটি সঠিক নয়। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো।”
তিনি বলেন, “ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতি। বর্তমান বিশ্বে ডলার কেন্দ্রিক যে বাণিজ্য ব্যবস্থা রয়েছে সেটির বিপরীতে একটি বিকল্প মুদ্রা চালুর বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্মেলনে আলোচনা হবে।”
“ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বাংলাদেশের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলে মন্তব্য করেন মুনশি ফায়েজ।
দল ভারী করার কৌশল!
ব্রিকস নিয়ে খুব আশাবাদী নন বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “এখানে চীন রয়েছে, আবার ভারতও রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি খুব ভালো অবস্থায় নেই, ব্রাজিলের অর্থনীতিও তেমন শক্ত নয়। এখান থেকে কতটুকু সুবিধা আমরা পাব সেটিও বলা কঠিন।”
“আমার মনে হয়, এর মাধ্যমে দল ভারী করার একটি চেষ্টা রয়েছে। তবে দল ভারী করলেই যে পশ্চিমারা এটিকে খুব নেতিবাচকভাবে নেবে সেটিও মনে হয় না,” বলেন তিনি।
আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক অথবা এডিবির বিকল্প হবে না ব্রিকস। ব্রিকস কি বিশ্বব্যাংকের মতো স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারবে? আমার মনে হয় না।”
“তবে এই জোটের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালো হলেও সেসব রাষ্ট্র আবার বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমাদের বিকল্প নয়,” মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
উল্লেখ্য, রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা গত বছর ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ ৪০টির বেশি ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
কিন্তু ব্রিকসকে পুরোপুরি একটি পশ্চিমাবিরোধী ফোরামে রূপান্তরে আগ্রহী নয় ভারত ও ব্রাজিল। তাই জোটে যোগ দিতে গেলে আপাতত অপেক্ষায় থাকতে হবে বাংলাদেশসহ আগ্রহী দেশগুলোকে।