সর্বজনীন পেনশন চালুর প্রত্যাশা নিয়ে সংসদে বাজেট পেশ
2023.06.01
ঢাকা
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আশা করছি, ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা সম্ভব হবে।”
অর্থমন্ত্রী জানান, প্রস্তাবিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের অধিক বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর পর্যন্ত কিস্তি প্রদান সাপেক্ষে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকরাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে নোমিনি পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন।”
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছরের চাঁদা প্রদান করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নোমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়া চাঁদাদাতা জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবেও উত্তোলন করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী জানান, পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর বিপরীতে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
শিগগির একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এই কর্তৃপক্ষকে কার্যকর করা হবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “পেনশন ব্যবস্থার সুবিধার ব্যাপারে সব নাগরিককে সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে এবং এটি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “পেনশন তহবিলের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থাকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নজরদারি করার পাশাপাশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে।”
গত বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বড়ো বাজেট
সংসদে পেশের আগে বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা।
‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সংসদে পেশ করা এবারের বাজেটের আকার সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ছয় লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেট আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ১৫.৫০ শতাংশ বেশি।
সংসদে অর্থমন্ত্রী জানান, এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতির বার্ষিক হারের লক্ষ্য থাকছে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ।
আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র পেতে ন্যূনতম কর
বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র পেতে করদাতাকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
সব মিলিয়ে ৪৪ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার রশিদ লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন থেকে এসব সেবা পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে সেবা গ্রহীতাকে।
“রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে সরকারকে ন্যূনতম কর প্রদান করে সরকারের জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ,” বলেন অর্থমন্ত্রী।
দাম বাড়বে-কমবে যেসব ক্ষেত্রে
বাজেটে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশ পাস হলে যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে তার মধ্যে রয়েছে—বলপেন, থালা-বাসন, খেজুর, চশমা ও সানগ্লাস, টিস্যু, মোবাইল ফোন, গ্যাস সিলিন্ডার, সিগারেট, তরল নিকোটিন, বাসমতী চাল, কাজুবাদাম, বাইসাইকেল, আঠা, সিমেন্ট, সাধারণ ইট, সফটওয়্যার, বিদেশি লিফট এবং বিদেশি স্যান্ডউইচ প্যানেল।
একইভাবে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশ পাস হলে যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে তার মধ্যে রয়েছে—হাতে তৈরি বিস্কুট ও কেক, মিষ্টি, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার ওষুধ, পশুখাদ্য, অপটিক্যাল ফাইবার, উড়োজাহাজ ইজারা, কনটেইনার, ব্লেন্ডার, জুসার এবং প্রেশার কুকার।
তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়া
জাতীয় সংসদের ৫২তম আর আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের ১৫তম বাজেট ঘোষণার পর সংসদ এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “এই বাজেট হচ্ছে সংকটে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট। এটি একটি জনবান্ধব বাজেট।”
বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি’র স্থায়ী কিমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বাত্মকভাবে করারোপের সমালোচনা করেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “বাজেটের আকার বাড়ছে ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে এবং তা করা হচ্ছে সরকারের লুটপাটের সুবিধার জন্য।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “যে চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের সামনে রয়েছে; বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে প্রস্তাবিত বাজেটে এটা খুব একটা স্পষ্ট আকারে এসেছে বলে মনে হয়নি।”
প্রস্তাবিত বাজেটকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং এ বাজেট দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর সংবাদ সম্মেলনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মূল্যস্ফীতির চাপ ও পণ্য মূল্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য বাজেটে যেসব সমাধান দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয় দাবি করে তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার যে কথা বলা হয়েছে সেটাও এই বাজেটের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে না।”