তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.12.17
ঢাকা
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা  ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি'র দলীয় কার্যালয় থেকে দলীয় সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল।৩০ ডিসেম্বর ২০২২।
[সনি রামানী/বেনারনিউজ]।

এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে  সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলোপ করা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ সুগম হয়েছে।

মঙ্গলবার হাইকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান আওয়ামী লীগ চালু করেছিল, তা বাতিল হয়ে গেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাংলাদেশ ‘সংবিধানের মূল কাঠামো’ হিসাবে বর্ণনা করে উচ্চ আদালত বলেছে,  দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে এই সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদ।

এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “এই (অন্তর্বর্তীকালীন) সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রিনেমড হতে পারে।  যেমন জেলা ও দায়রা জজ একই ব্যক্তি, যখন সিভিল মামলা করেন তখন তাকে বলা হয় জেলা জজ, আবার ওই একই ব্যক্তি যখন ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করেন তখন তিনি দায়রা জজ। তেমনি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যক্তিরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেমে চলে যাবে, ওনারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হবেন।  

সরকারের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানানো হয়, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

২০১১ সালের ১০ মে এক রায়ে সংবিধানে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ হিসাবে রায় দেন সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ।

সেই রায়ের দেড় মাস পর ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংসদ।

06a1044f-b718-45c5-b41a-141bc8cd8ea8.jpeg
ঢাকার নয়াপল্টনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল।৩০ ডিসেম্বর ২০২২। [সনি রামানী/বেনারনিউজ]।

গণ আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে তাঁর সরকারের পতন হয়।  এই প্রেক্ষাপটে সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ কয়েকজন ব্যক্তি সংবিধানের এই সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন।

মঙ্গলবার সেই আবেদন নিষ্পত্তিকালে আদালত জানান, সংবিধানের ওই সংশোধনীর পুরোটি বাতিল করা হয়নি। কেবলমাত্র পাঁচটি সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সংশোধনীগুলোর বিষয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে।

বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করে বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, “আদালত সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এটিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর একটি বলে বর্ণনা করেছেন।  সেই বিচারে সংসদ এই বিধান বাতিল করতে পারে না। এই সংশোধনী ছিল অসাংবিধানিক।”

রিটকারী বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে মৌলিক কাঠামোর একটি বলে বর্ণনা করেছেন।  এটি ভবিষ্যতে কোনও সংসদ বাতিল করতে পারবে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি হিসাবে বর্ণনা করার বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “মৌলিক কাঠামো সম্পর্কে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।  সেকারণে হয়তো আদালত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সেভাবে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “মৌলিক কাঠামোকে সংসদ কোনওভাবেই পরিবর্তন করতে পারে না।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শাহদীন মালিক বলেন, “যেমন গণতন্ত্র হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি।  এমন যদি হতো, শেখ হাসিনা সংসদে সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশকে রাজতন্ত্রে পরিণত করলেন।  তিনি চলে গেলে উনার ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবেন।  তাহলে সেটি কি গ্রহণযোগ্য হতো?”

 তিনি বলেন, “যেহেতু গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি, সেজন্য এটি করা হলেও আদালতে গিয়ে বাতিল হয়ে যেত। কারণ সংসদে পাশ করা আইন সংবিধানসম্মত কি না সেটি দেখার সাংবিধানিক দায়িত্ব আদালতের।”

যেভাবে এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার

বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি উপনির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে  ক্ষমতাসীন দলের বাইরে নিরপেক্ষ প্রশাসনের আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক ব্যবস্থার দাবি জানান শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে বিএনপি।  তখন থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পর পর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বলে অভিযোগ করে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ প্রায় সব বিরোধীদল।

২০১৮ ও ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে।

অসাংবিধানিক সরকার আসবে: আওয়ামী লীগ

আদালতের রায়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে আদালত বাংলাদেশে অসাংবিধানিক সরকার আসার পথ সুগম করে দিল।  ভবিষ্যতে দেশে সাংবিধানিক ধারা থাকবে না এবং যারা এ ধরনের অপরাধ করবে তাদের কিছু হবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।