ঢাকায় পানি সরবরাহ: কাজ পেলো আগে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত চীনা কোম্পানি
2021.03.25
ঢাকা
বাংলাদেশে পানি প্রকল্পে আবারো কাজ পেয়েছে এমন একটি চীনা কোম্পানি, যাদেরকে কাজ দিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে কয়েক বছর আগে ওয়াসা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার ওই চীনা প্রতিষ্ঠান, চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে ওয়াসার ৭৭৭ কোটি টাকা বা নয় কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পের কাজের অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
বিনা দরপত্রে ওই কোম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের তহবিল ক্ষতি করার অভিযোগে ২০১৫ সালে ওয়াসার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দুদক। তদন্তের পর তাঁকে দায়মুক্তি দেয়া হলেও বিশ্লেষকদের মতে, যে কোম্পানির বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করেছে সেই কোম্পানিকে কাজ দেয়া উচিত হয়নি।
এই একই কোম্পানি ২০১৯ সালে ওয়াসার আরেকটি ৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রকল্পের কাজ পায়।
তবে একই কোম্পানিকে বারবার কাজ দেবার বিষয়ে আইনি সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন ওয়াসার কর্মকর্তারা।
“আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, যে কোম্পানি সর্বনিম্ন দর অফার করবে তাদের কাজ দিতে হবে,” বেনারকে জানান ওয়াসার নতুন প্রকল্পের পরিচালক মাহমুদুল ইসলাম।
“চীনা কোম্পানিগুলো আমাদের দরপত্রে অংশগ্রহণ করে এবং সর্বনিম্ন দর দেয়। অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো উচ্চ হারে দর দেয়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সে কারণে আমরা চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না।”
“যদি চীনা এই কোম্পানি বিতর্কিত কোনো কাজ করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দাতা সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নেয় না কেন? তারা ব্যবস্থা না নিলে আমাদের কিছু করার নেই। এটি আমাদের আইনগত সীমাবদ্ধতা,” বলেন মাহমুদুল ইসলাম।
“এটি মূলত দাতা সংস্থার অর্থে পরিচালিত একটি প্রকল্প। মোট ৭৭৭ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা আসবে দাতাদের কাছ থেকে,” বলেন প্রকল্প পরিচালক।
তবে কোনো কোম্পানিকে দাতাগোষ্ঠী কালো তালিকাভুক্ত না করলে সরকারের কিছু করার নেই কথাটির সাথে দ্বিমত করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর আহসান এইচ. মনসুর।
তিনি বেনারকে বলেন, কোনো কোম্পানিকে ঘুষ-দুর্নীতি অথবা অন্য কোনো কারণে সরকার তালিকাভুক্ত করলে “দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবস্থা নেবে।”
“সুতরাং, একটি বিতর্কিত চীনা কোম্পানিকে কাজ দেয়ার দায় শুধু দাতা সংস্থাগুলোর নয়, সরকারেরও দায় আছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করেছে সেই কোম্পানিকে কাজ দেয়া উচিত হয়নি।”
“সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ওই চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলার কারণ হলো, এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে,” বলেন অধ্যাপক মনসুর।
বাংলাদেশসহ এশিয়ার প্রায় সকল দেশে কাজ পাওয়ার জন্য চীনা কোম্পানিগুলো সর্বনিম্ন দর অফার করে জানিয়ে তিনি বলেন, “সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে কাজ পাওয়ার পর তারা দফায় দফায় খরচ বৃদ্ধি করে।”
“কারণ একবার কোনো কোম্পানিকে কাজ দেয়ার পর তাদের বাদ দেয়া যায় না। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। কাজের মান ভালো হয় না,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “পুরো এই প্রক্রিয়ার সাথে সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা থাকে। অন্যথায় এধরনের কাজ সম্ভব হতো না।”
এ প্রসঙ্গে চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের বক্তব্য জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ই-মেইল পাঠানো হলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
দুদকের তদন্ত
পদ্মা জশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ. খানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সেই অনুসন্ধানের বিষয় ছিল, বিনা দরপত্রে মেসার্স সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে প্রায় তিন হাজার সাত কোটি টাকার কাজ দিয়েছেন তিনি। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাষ্ট্রের প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয় বলে জানানো হয়।
তবে পরবর্তীতে এই অভিযোগ থেকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়মুক্তি দেয় দুদক।
অভিযোগ উত্থাপিত হলেও ২০১৯ সালে এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্টের ৬৬ মার্কিন ডলার মূল্যের কাজ পায় সেই একই চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।
এই প্রকল্পের আওতায় নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে সেটি পরিশোধন করে ঢাকা শহরে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৪২ শতাংশের বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রকল্প পরিচালকের প্রতিবেদনে।
বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার হতে বারিধারা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার পরিশোধিত পানি বিতরণ লাইন স্থাপন নির্মাণ করা হবে বলে বেনারকে জানান প্রকল্প পরিচালক মাহমুদুল ইসলাম।
তিনি জানান, চলতি বছরের অক্টোবরেই শুরু হবে পানি বিতরণ লাইনের কাজ, এবং পুরো প্রকল্পটি শেষ হবে আগামী তিন বছরের মধ্যে। এর মাধ্যমে ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে মানুষকে সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পের দাতাদের কাছ থেকে আসা ৫০০ কোটি টাকার ৭০ ভাগ ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও ৩০ ভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে আসবে বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।