চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুলবে বাংলাদেশ
2024.03.25
ঢাকা
বাণিজ্য সহজ করা এবং চলমান মার্কিন ডলার সংকটের চাপ কমানোর জন্য চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খোলার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট ওপেন করব।”
তবে কবে নাগাদ এই অ্যাকাউন্ট খোলা হবে সে বিষয়টি এখনো ঠিক হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এটি খোলা হবে।”
এই অ্যাকাউন্ট খুললে কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, “চায়নার সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। এই অ্যাকাউন্টটি ওপেন হলে চাইনিজ মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ইউয়ানে এলসি খুলতে পারবেন।”
তিনি বলেন, তৃতীয় পক্ষের লেনদেনের ক্ষেত্রেও সুবিধা পাওয়া যাবে এই অ্যাকাউন্ট থেকে।
সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অনেকগুলো ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ ছাড়া রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটমকে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়াকে ঋণের টাকা ইউয়ানে পরিশোধ করার। সে ক্ষেত্রে চায়নার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হলে এই ঋণ পরিশোধে কোনো সহজ সুযোগ তৈরি হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, “শুধু রাশিয়া নয়। আরো অনেক রকম তৃতীয় পক্ষের লেনদেন সহজ করার ক্ষেত্রে এই অ্যাকাউন্ট ভূমিকা রাখবে।”
হঠাৎ কেন বাংলাদেশ এমন উদ্যোগ নিলো-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ইউয়ান আমাদের পাঁচটি অফিসিয়াল অ্যাপ্রুভ কারেন্সির মধ্যে একটি। অন্য যেসব অফিসিয়াল কারেন্সি আছে সেসব দেশেও আমাদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এতদিন চায়নায় খোলা হয়নি, এখন আমরা খুলতে চাচ্ছি।”
ব্যবসায়ীদের ‘বিশাল সুবিধা হবে’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা।
সোমবার তিনি বেনারকে বলেন, “চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমরা মনে করি, সেরকম উদ্যোগেরই একটি অংশ হচ্ছে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা।”
তিনি বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে চায়নার সঙ্গে যারা ব্যবসা করেন তাঁদের জন্য বিশাল সুবিধা হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন এই উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, এই উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
প্রসঙ্গত চায়নার ইউয়ান ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর চারটি বৈদেশিক মুদ্রা হলো—ইউএস ডলার, ইউরো, পাউন্ড ও ইয়েন।
বর্তমানে ১১টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট রয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা মেজবাউল জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, ফ্রান্সসহ অন্যান্য ব্যাংকে থাকা এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের লেনদেন হয়।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখন থেকে যে কোনো লেনদেন চীনের মুদ্রায় তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করতে পারবে। ব্যাংকিং সেক্টরে এই পদ্ধতি 'রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট' বা আরটিজিএস নামে পরিচিত।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক অংশীদার চীন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ৭৮২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য চীনে রপ্তানি করেছে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে তৎপরতা সরকার দেখাচ্ছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে গত জাতীয় নির্বাচনের সময়ে দেশটির কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া।
“সরকার নির্বাচনে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সমর্থন পেয়েছে। এখন এসব দেশ সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা পাবে- এটা খুবই অনুমেয়,” বলেন এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে আমেরিকা ও ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু বাংলাদেশের বড়ো বাজার। তাই সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বাজায় রাখার ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “সম্পর্ক রাখতে হবে, কিন্তু খেয়াল রাখত হবে একদিকে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে অন্যদিক যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ'
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে ‘সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ'।
রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে এ সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, যেখানে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক চেন ডংঝিয়াও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন।
এ সময় মাকসুদ কামাল বলেন, “চীনের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিনিময় এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনে সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
ইয়াও ওয়েন বলেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিশেষ করে শিক্ষা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে এই সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।