চট্টগ্রামে এস আলম ও চীনের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সহিংসতা, পুলিশের গুলিতে ৫ শ্রমিক নিহত

শরীফ খিয়াম
2021.04.17
ঢাকা
চট্টগ্রামে এস আলম ও চীনের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সহিংসতা, পুলিশের গুলিতে ৫ শ্রমিক নিহত চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সাথে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সংঘর্ষে আহত এক শ্রমিককে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ১৭ এপ্রিল ২০২১।
[বেনারনিউজ]

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশি এস আলম গ্রুপ ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানার নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে তিন পুলিশসহ অন্তত ১৫জন। 

“নিহত সবাই ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক,” বেনারকে বলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন। 

সংঘর্ষে ১২ জন শ্রমিক ও তিন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন জানিয়ে ডিআইজি বলেন, “এ ঘটনায় বাঁশখালী থানায় একটি মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।” 

এসএস পাওয়ার নামে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে বকেয়া বেতন-ভাতা আদায়সহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকেরা শনিবার সকালে সেখানে কর্মরত চীনাদের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করলে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। 

“পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে চীনা নাগরিকেরা আক্রান্ত হতেন। সেখানকার পরিস্থিতি ওই দিকেই যাচ্ছিল,” বলেন ডিআইজি। 

ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশি একটি ঠিকাদারি কোম্পানিতে কাজ করা মশিউর রহমান বেনারকে বলেন, “সকালে শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন শুরু করেছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা প্রকল্পের ভিতরে প্রবেশ করে চীনাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের রক্ষা করতেই পুলিশ গুলি চালিয়েছে।” 

“যখন ঘটনাটি ঘটে তখন আমি ভিতরেই ছিলাম। যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে শত শত লোক মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল,” বলেন তিনি। 

মশিউরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বর্তমানে ২০-২২টি চীনা এবং দুই-তিনটি বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু চীনা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুই-তিন মাসের বেতন বকেয়া ছিল। 

মশিউর জানান, ওইসব প্রতিষ্ঠানে রমজান মাসের ‘ডিউটি আওয়ার’ (কাজের সময়) নিয়েও সমস্যা হচ্ছিল। এক শ্রমিক ইফতারের জন্য আধঘণ্টা আগে বেরিয়ে যাওয়ায় তাঁর মজুরি কেটে রাখা এবং আরেক শ্রমিক জুম্মার নামাজে অংশ নিতে যাওয়ায় তাঁকে চাকুরিচ্যুত করার জের ধরে ঝামেলা তৈরি হয়। 

এরপরই রমজান মাসে দুপুরের দুই ঘণ্টার বিরতি বাতিল করে ইফতারের আগে ডিউটি শেষ করা, শুক্রবার জুমার নামাজ উপলক্ষে আধা বেলা হাজিরায় পুরো বেতন দেওয়া ও বিনা নোটিশে ছাঁটাই বন্ধসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। 

মশিউর বলেন, আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। 

তাঁর মতে, “ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী স্থানীয় একটি চক্র শনিবার শ্রমিকদের সাথে একাত্ম হয়ে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। মূলত এরপরই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে।"

প্রকল্পে প্রায় এক হাজার চীনা নাগরিক এবং চার হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন বলেও জানান তিনি। 

210417_BD_CH_UNREST_BURNED1.JPG
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ধরিয়ে দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রকল্পের কিছু গাড়ি ও যন্ত্রপাতি। ১৭ এপ্রিল ২০২১। [বেনারনিউজ]

পরিস্থিতি এখন ‘নিয়ন্ত্রণে’

প্রকল্পে সব সময় কমপক্ষে আটশ থেকে এক হাজার চীনা নাগরিক থাকেন উল্লেখ করে বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এলাকাবাসীর কিছু উসকানি ছিল বলে জানা গেছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”

“সার্বিক পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। দুই পক্ষকে নিয়ে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া চীনারা মেনে নিয়েছে,” বলেন তিনি। 

ইউএনও জানান, যারা নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। যারা আহত তাঁদের নগদ ৫০ হাজার টাকার পাশাপাশি চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে। 

চীনাদের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান ডিআইজি ও ইউএনও। 

বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ লেয়াকত আলী বেনারকে জানান, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করা তার এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা তাঁকে জানিয়েছে, মূলত চীনাদের সাথেই শ্রমিকদের সমস্যা হয়েছে। 

“আমার এলাকার ১৮-১৯ বছর বয়সী একটি ছেলে মারা গেছে। সে ওখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, চীনের ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চারজন ও ২০১৭ সালে পৃথক সংঘর্ষে আরো একজন নিহত হয়েছিলেন। 

মূলত জমি অধিগ্রহণের ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে ২০১৬ সালে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। 

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবহন, ব্যাংক, স্টিল, মিডিয়া, টেক্সটাইল, রিয়েল স্টেটসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই গ্রুপের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। 

এস এস পাওয়ার লিমিটেডের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে। 

শনিবারের সহিংস ঘটনা সম্পর্কে এস আলম গ্রুপ আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। বেনারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়েও জবাব মেলেনি। 

তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এই প্রকল্প সময়মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারছে না। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর এস আলম গ্রুপ এ প্রকল্পটির জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও এসএস পাওয়ারের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) ও নির্মাণ চুক্তি (আইএ) হয়। 

সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা। 

চুক্তি অনুযায়ী পিডিবি ২৫ বছর ধরে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ কিনবে। 

তবে “২০২৩ সালে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই”, বলে বেনারকে জানান সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। 

“শনিবারের ঘটনায় বিদ্যুৎ বিভাগের তেমন কিছু করণীয় নেই,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বেসরকারি এই কোম্পানিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছি। এর ব্যবস্থাপনায় সরকারের করণীয় কিছু নেই।” 

প্রথম থেকে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল উল্লেখ করে সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সমন্বয়ক খান আসাদুজ্জামান মাসুম বেনারকে বলেন, “এখানে বাংলাদেশি যে কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে, সেটি একটি লুটেরা এবং আধিপত্যবাদী কোম্পানি।” 

স্রেফ বাণিজ্যের খাতিরে জনমতের বিরুদ্ধে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, শুরুতেই কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন স্থানীয়রা। এরপর বিভিন্ন সময়ে সেখানে শ্রমিকদের জুলুমের খবর পাওয়া গেছে। জনবিরোধী এই প্রকল্প বন্ধ হওয়া উচিত। 

নিন্দা ও প্রতিবাদ

পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহতের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশের ৬৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বকেয়া মজুরির দাবিতে সমাবেশরত নিরীহ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ একটি গর্হিত অপরাধ ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য লজ্জাকর।” 

এই ঘটনা আইনের শাসনের পরিপন্থী উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে এর আগে হতাহতের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার হয়নি। 

নিহত ও আহতদের শ্রম আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ শ্রমিক অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের চট্টগ্রাম শাখার নেতারা। 

বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন এই ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার বিকেলে ঢাকায় বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে শনিবার বিকেলেই বিক্ষোভ করেছে বাম সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীরা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।