আদালত: বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্পে শ্রমিক হত্যায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কেন নয়?
2021.05.04
ঢাকা

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত সাত শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়া হবে না, তা ৪৫ দিনের মধ্যে সরকারকে তা জানাতে বলেছে হাইকোর্ট।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-সহ পাঁচ সংগঠনের করা পৃথক দুটি রিটের শুনানিকালে মঙ্গলবার আদালত এই রুল জারি করে।
শুনানিতে অংশ নেওয়া সরকারি আইনজীবী বিপুল বাগমার বেনারকে বলেন, “স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ও শ্রম অধিদপ্তরসহ সবার সাথে আলাপ করে এই রুলের জবাব দেবে রাষ্ট্রপক্ষ।”
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ এবং চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানায় গড়ে ওঠা এসএস পাওয়ার আই লিমিটেড নামের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত ১৭ এপ্রিলের সহিংসতার ঘটনায় প্রশাসন ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনও একই সময়ের মধ্যে দাখিল করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
“ওই সব তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে,” বলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল।
আসকের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন বেনারকে বলেন, “নিহতদের আপাতত পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।”
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী মো. আরশাদুল রউফ আদালতকে বলেন, নিহতদের পরিবারকে ইতোমধ্যে তিন লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, “তিন লাখ খুবই সামান্য টাকা। আপাতত আরও দুই লাখ টাকা দেবেন।”
“নিহত শ্রমিকদের পরিবার প্রতি তিন কোটি এবং আহতদের পরিবার প্রতি দুই কোটি টাকা করে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে,” বলেন সৈয়দা নাসরিন।
“বাঁশখালীর শ্রমিক ও গ্রামবাসীকে হয়রানি না করতেও প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আহতদের চিকিৎসা ও সব শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে বিষয়েও প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে,” যোগ করেন আসকের এই আইনজীবী।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এসব আদেশ দেন।
সহিংসতার ঘটনায় বাঁশখালী থানায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক ও স্থানীয়দের আসামি করে পুলিশ ও মালিক পক্ষের দায়ের করা দুই মামলার তদন্তকারী বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, কেউ হয়রানির শিকার হয়নি।”
“তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লুট হওয়া ৪০-৪৫ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করেছে পুলিশ,” বলেন এই কর্মকর্তা।
বিদুৎকেন্দ্রে আবার কাজ শুরু হয়েছে, গত শুক্রবার পর্যন্ত কমপক্ষে আড়াই হাজার শ্রমিক কাজে ফিরে এসেছেন বলেও জানান আজিজুল ইসলাম।
ঘটনার দিনই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থানকারী চীনা নাগরিকদের সুরক্ষার স্বার্থে গুলি চালানোর কথা বেনারকে বলেছিলেন চট্টগ্রাম পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আর শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন, কয়েকটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বকেয়া বেতনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলন করার কথা।
অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধ
সহিংসতায় আহত শ্রমিক মোহাম্মদ মিজানের বড়ো ভাই মোহাম্মদ ফিরোজ মঙ্গলবার বিকেলে বেনারকে বলেন, “ওই ঘটনার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ৫০ হাজার টাকা দিলেও হাসপাতালে তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। টাকার অভাবে মিজানের চিকিৎসা শেষ না করে তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান গত সপ্তাহে (২৬ এপ্রিল) শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে নিহত সাতজন শ্রমিকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা এবং আহত ১৫ শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা পাননি বলে বেনারকে জানিয়েছেন ফিরোজ।
“টাকাটা পেলে খুব উপকার হতো। ভাইটাকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারতাম,” বলেন তিনি।
নিহত শ্রমিক মো. রায়হানের ভাই মো. রাফোল উদ্দিন রাহুল বেনারকে বলেন, “টেলিভিশনের খবরে সরকারের সহায়তা দেওয়ার কথা আমরাও জেনেছি। কিন্তু আমাদের সাথে কেউ যোগাযোগ করেনি।”
“তবে এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য না করতে নিহতদের পরিবার ও আহতদের ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে মালিকপক্ষ,” অভিযোগ করেন আসকের আইনজীবী।
বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ার লিমিটেড নামের ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের ঘটনায় ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চারজন ও ২০১৭ সালে পৃথক সংঘর্ষে আরো একজন নিহত হয়েছিলেন। এবার মারা গেছেন সাতজন।
বাংলাদেশের শিল্পগ্রুপ এস আলমের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে।
প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি ও প্রায় এক হাজার চীনা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা।
বিচার বিভাগই শেষ ভরসা
শুরু থেকেই বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতাকারী তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “সেখানে আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রকৃত তদন্ত হয়নি। এবারও পুলিশ, প্রশাসন বা মালিকপক্ষের অনুসন্ধানে সত্য বের হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না।”
“এক্ষেত্রে বিচার বিভাগই শেষ ভরসা,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি হলেও নাগরিক নজরদারি জারি রাখতে হবে, যাতে সরকার বা প্রভাবশালী মালিকপক্ষ তদন্ত প্রভাবিত না করতে পারে।”
ওই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতাগুলোর দায় চীন সরকার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে গত শুক্রবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের ৮১ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
এই নাগরিকদের একজন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, দূতাবাসের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত জবাব পাননি তাঁরা।
“শেষ পর্যন্ত কিছুই না হলে নাগরিক কমিশন গঠন করে আমরা জনগণকে জানাব সেখানে আসলে কী ঘটেছিল,” যোগ করেন তিনি।
এর আগে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বেনারকে বলেছেন, বাঁশখালী ঘটনায় সরকারি তদন্তের ফলাফল সবাইকে জানানো এবং তা নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।