চীনা কোম্পানির তৈরি ত্রুটিপূর্ণ পরিশোধন ব্যবস্থা: বিপজ্জনক দূষণের কবলে ধলেশ্বরী নদী

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.08.24
ঢাকা
চীনা কোম্পানির তৈরি ত্রুটিপূর্ণ পরিশোধন ব্যবস্থা: বিপজ্জনক দূষণের কবলে ধলেশ্বরী নদী সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারে কাজ তদারকি করেছেন এক চীনা নাগরিক। ৯ নভেম্বর, ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

সাভারের চামড়া শিল্পনগরী থেকে নির্গত ক্ষতিকর উপাদান সরানোর জন্য কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একটি চীনা কোম্পানিকে। সেই কোম্পানি কাজ শেষে করে চলে যাবার এক মাসের মাথায় সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে, চামড়াশিল্প থেকে উৎপাদিত সবচেয়ে মারাত্মক ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই ওই পরিশোধন ব্যবস্থায়। 

এই পরিস্থিতিতে ধলেশ্বরী নদীকে রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে চামড়া শিল্প নগরী বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরও কমিটির সাথে একাত্মতা জানিয়েছে। তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতে, চামড়া শিল্পনগরীকে বন্ধ করা যাবে না। 

ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সকল চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানকে ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থাপিত ওই শিল্পনগরীতে সরিয়ে নেয়া হয়। ইটিপি স্থাপন করা হলেও গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে ক্রোমিয়ামসহ চামড়া শিল্পের দুষিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের নদীপাড়ের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

এরই মধ্যে গত জুলাই মাসে ইটিপি সরকারের কাছে হস্তান্তর করে চলে গেছে চীনা কোম্পানি জিয়াংশু লিংঝি ইনভায়রেনমেন্টাল প্রোটেকশন কোম্পানি লিমিটেড। উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনা দূতাবাসে ই–মেইল পাঠিয়ে মঙ্গলবার বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও এর জবাব পাওয়া যায়নি। 

হেমায়েতপুরের এই চামড়া শিল্পনগরীর দূষণ নিয়ে আলোচনা হয় সোমবারের স্থায়ী কমিটির সভায়। সভা শেষে সাবের হোসেন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সাভারের ট্যানারি শিল্প নগরীতে প্রতিদিন ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। আর ইটিপি শোধন করতে পারে ২৫ হাজার ঘনমিটার। অর্থাৎ দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পানিতে মিশছে।” 

“গত তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হয়েছে,” বলেন তিনি। 

তিনি বলেন, “বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ট্যানারি থেকে উৎপন্ন সবচেয়ে ক্ষতিকর বর্জ্য ক্রোমিয়াম আলাদা করার কোনো ব্যবস্থা নেই এই ইটিপিতে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত যত বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়েছে, সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ক্রোমিয়াম রয়েছে এবং এটা চলছে। এজন্য আমরা এখনই ওই শিল্পনগরী বন্ধ রাখতে বলেছি।” 

সাবের হোসেন বলেন, “দূষণ বন্ধের জন্যই হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি কারখানাগুলো নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লাভ তো হলো না। এখান আরেকটি নদী দূষিত করা হচ্ছে।” 

আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিসেস কন্ট্রোল জানায়, ক্রোমিয়াম ধাতু পরিবেশ ও মানবকুলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ক্রোমিয়ামের সংস্পর্শে আসলে মানুষের ফুসফুসের রোগ, শ্বাসকষ্ট, সাইনাস, ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ হয়। 

কারখানা বন্ধ করলে ক্ষতি হবে লাখ লাখ মানুষের

বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী চামড়া কারখানাগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। তবে কোনোরকম পরিশোধন ছাড়াই চামড়া শিল্পের বিভিন্ন বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে মৃত হয়ে পড়ে ঢাকার প্রাণ হিসাবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদ। 

এই শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় সরকার।

২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৭ সালে এক হাজার ১৫ কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ হয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন চামড়া এস্টেট প্রকল্পের পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল।

আদালতের নির্দেশে হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁদের কারখানা সাভারে সরিয়ে নেন। 

“আমরা স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জেনেছি এবং কমিটির সাথে আমরাও একমত। ধলেশ্বরী নদীতে এভাবে শোধন ছাড়া বর্জ্য ফেলা বন্ধ হোক। এ কারণেই সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া হয়নি,” বেনারকে বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক। 

জিয়াউল হক বলেন, “বিসিকের চেয়ারম্যান আমাদের জানিয়েছেন, এই চামড়া শিল্পনগরীতে ১২৩টি কারখানা রয়েছে। এখান থেকে বছরে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়। যদি এই কারখানা বন্ধ করা হয় তাহলে পুরো চামড়া শিল্পে ধস নামবে। সেকারণে সরকার এই চামড়া শিল্প নগরী বন্ধ করতে চাইবে না।” 

তিনি বলেন, “যে কোম্পানি ইটিপির এই কাজ করেছে, তারা ক্রোমিয়াম আলাদা করার ব্যবস্থা রাখেনি। তবে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলোও তাদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা করেনি।” 

এদিকে “তৈরি পোশাক খাতের পরে চামড়া শিল্প আমাদের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানি খাত,” জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “এই খাতে লাখ লাখ মানুষ জড়িত। আমার মনে হয়, এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়।” 

তিনি বলেন, “চামড়া শিল্পনগরীতে যে ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে সেটি সঠিকভাবে করা হয়নি। এখানে ক্রোমিয়াম ধাতু আলাদা করার ব্যবস্থা চীনা কোম্পানি রাখেনি। তারা কাজ করে চলে গেছে।” 

এই ইটিপি আগে চীনা কোম্পানি পরিচালনা করত জানিয়ে সাখাওয়াত বলেন, “তারা ইটিপি আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আমরা ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়ে একটি কোম্পানি গঠন করে তাদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি।” 

“নিয়ম অনুযায়ী, ট্যানারির বর্জ্য থেকে প্রথমেই ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম আলাদা করার পর সেই তরল বর্জ্য ইটিপিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু চীনা কোম্পানি এই ব্যবস্থা রাখেনি। সুতরাং, ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম অবাধে ধলেশ্বরী নদীতে চলে যাচ্ছে। এটি পরিবেশ, মানুষ এবং জীবকুলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর,” বলেন তিনি। 

সাভারের চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল বেনারকে বলেন, “চীনা কোম্পানি পাঁচ বছর ইটিপি পরিচালনা করে চলে যাওয়ার পর আমরা ট্যানারি মালিকদের নিয়ে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট লিমিটেড গঠন করেছি।” 

তিনি বলেন, “প্রকল্পের মোট খরচ এক হাজার ১৫ কোটি টাকা থেকে ২৫ কোটি টাকা আমরা কেটে নিয়েছি। কারণ তারা একটি মেরামত কারখানা করেনি এবং যে জেনারেটর দিয়েছে তা ছিল নিম্নমানের।” 

বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য ও জুতা প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিল্পনগরী বন্ধ করে দিলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।” 

তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এই প্রকল্পটিকে আধুনিকায়ন করে ব্যবহার উপযোগী করা হোক। তবে যতদিন এটিকে আধুনিক করা যাবে না ততদিন ট্যানারিতে পানির ব্যবহার কমিয়ে ইটিপি’র কার্যক্রম চালু রাখতে হবে, যাতে নদী দূষিত না হয়,” বলেন সাইফুল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।