বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে দুই চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিক্ষোভ
2022.05.12
ঢাকা
করোনাভাইরাস মোকাবেলার অজুহাতে দেশের একমাত্র কয়লা খনি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় গত দুই বছর ধরে শ্রমিকদের খনিতে আটকে রেখে অমানবিকভাবে কাজ করানোর অভিযোগ এসেছে খনি পরিচালনাকারী দুই চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে।
জোরপূর্বক কাজ বন্ধ করতে গত রোববার থেকে একটানা পাঁচদিন আন্দোলন করে যাচ্ছেন কয়লাখনির এক হাজারের বেশি স্থানীয় শ্রমিক, যাদের থাকতে দেয়া হয় অস্বাস্থ্যকর লোহার কন্টেইনার ও বস্তির ঝুপড়ি ঘরে।
কয়েকজন শ্রমিকের মা এবং সন্তান মারা গেলেও তাঁদের বের হতে দেওয়া হয়নি বলে বেনারকে জানান সেখানকার ভুক্তভোগী শ্রমিকরা।
শ্রমিক অধিকারকর্মীরা বলছেন, এই ধরনের কাজ দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির এক কর্মকর্তা বেনারের কাছে স্বীকার করেন যে, খনি প্রাঙ্গণে রেখে শ্রমিকদের কাজ করিয়েছে চীনা কোম্পানি এক্সএমসি-সিএমসি। করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে চীনা কোম্পানি এমন ব্যবস্থা নেয় বলে জানান তিনি।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির শ্রমিক মো. সোহাগ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “চীনা কোম্পানি এক্সএমসি-সিএমসি’র দেয়া লকডাউন তুলে নিয়ে কয়লাখনি খুলে দেয়ার দাবিতে আমরা গত রোববার থেকে বিক্ষোভ করে আসছি। কিন্তু কোম্পানি অথবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের দাবির প্রতি নজর দেয়া হচ্ছে না।”
সোহাগ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে কয়লা খনিতে প্রবেশ করে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সেখানে বন্দিদশায় কাজ করেন।
তিনি জানান, ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলে কয়লা খনির এক হাজার ৫০ জন শ্রমিকের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে চারশো শ্রমিককে কয়লা খনিতে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়।
“এই সকল শ্রমিকদের খনির বাইরে যেতে দেয়া হতো না। একটানা তিন মাস খনিতে কাজ করানো হতো। থাকার ব্যবস্থা করা হয় অস্বাস্থ্যকর লোহার কন্টেইনার ও বস্তিতে,” বলেন সোহাগ।
তিনি জানান, “সেখানে কেউ কারো সাথে মিশতে পারত না এবং পরিবারের কোনো সদস্যের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। সপ্তাহে একবার বাজার করে সাতদিন রান্না করতে হতো এবং খাবার মান ছিল নিম্ন।”
সোহাগ বলেন, “আমরা সেখানে জেলখানার মতো পরিবেশে কাজ করতাম। খনিতে আমরা ছিলাম বন্দি। কোনো স্বাধীনতা নেই। তারা যা বলবে এবং যেভাবে বলবে সেভাবেই কাজ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কোথাও লকডাউন নেই। করোনাভাইরাস নেই। সবকিছু খোলা। সরকার সবকিছু খুলে দিয়েছে। কিন্তু একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে চীনারা লকডাউন দিয়ে রেখেছে।”
সোহাগ বলেন, “আমাদের দাবি হলো, কয়লাখনি সম্পূর্ণ খুলে দিতে হবে এবং আমাদের সব কর্মীকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।”
খনি সম্পূর্ণ খুলে দেবার দাবি শ্রমিকদের
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো, রবিউল ইসলাম রবি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “লকডাউনের মধ্যে যারা খনিতে কাজ করেছে তাদের অনেকের মা মারা গেছেন, কারও সন্তান মারা গেছে। কিন্তু তারপরও করোনাভাইরাসের কথা বলে তাঁদের বের হতে দেয়া হয়নি। আটকে রাখা হয়েছে।”
তাঁর প্রশ্ন- “চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থাকলে আমাদের এখানে লকডাউনের কোনো দরকার আছে?”
রবি বলেন, “আমাদের বলা হচ্ছে আবারও লকডাউনে কাজ করতে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের গ্রেপ্তার করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। তবে যতই ভয় দেখাক, আমরা যৌক্তিক আন্দোলন বন্ধ করব না।”
বর্তমানে আন্দোলনরত শ্রমিকদের কাজে ফিরে আসার কথা বলা হলেও তাঁরা “কাজে যোগ দিচ্ছেন না,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির খনি পরিচালনা শাখার মহাপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম সরকার।
তিনি বলেন, শ্রমিকরা করোনাভাইরাসের সব ধরনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে খনি সম্পূর্ণ খুলে দিতে এবং তাঁদের সবার কাজের ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছেন।
“তবে চীনা কোম্পানি এক্সএমসি-সিএমসি এর কর্মকর্তারা কোভিড-১৯ নিয়ে শঙ্কিত। কারণ চীনে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে এবং সেখানকার কিছু শহরে লকডাউন চলছে। ভারতেও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
কয়লা খনিতে বায়ু চলাচলের জন্য একপাশ দিয়ে বাতাস দিলে অন্য প্রান্ত দিয়ে সেটি বেরিয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের একজন যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন, তাহলে সবাই ঝুঁকিতে পড়ে যাবেন।”
তিনমাস আগে প্রায় ১০০ জন চীনা কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে তারা “একটু বেশি সতর্ক,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
‘এক ধরনের আধুনিক দাসত্ব’
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে যেভাবে কাজ করানো হয়েছে সেটিকে “জোরপূর্বক শ্রম,” হিসেবে আখ্যায়িত করে শ্রম নিয়ে গবেষণাকারী ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ স্টাডিজের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বেনারকে বলেন, “এটি এক ধরনের আধুনিক দাসত্ব।”
তিনি বলেন, “কোনো শ্রমিককে আটকে রেখে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না দিয়ে মাসের পর মাস কাজ করানো জাতিসংঘ শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধানের সম্পূর্ণ বিরোধী। বাংলাদেশ আইএলওর এই বিধান অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। সেহেতু বাংলাদেশে কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারে না।”
“বড়পুকুরিয়ায় যেভাবে কাজ করানো হচ্ছে সেটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন,” বলেন অধ্যাপক জাকির।
উত্তরের জেলা দিনাজপুরে দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়া অবস্থিত। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারের ভূতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯৮৫ সালে এই কয়লাখনি আবিষ্কার করে। এখানকার কয়লায় সালফারের পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ার এর মান অনেক ভালো।
এই খনির কয়লা উত্তোলনে ২০০৫ সালের ৪ জুন চীনা কনসোর্টিয়াম এক্সএমসি-সিএমসি এর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ওই কোম্পানির মাধ্যমেই কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।
চীনা কর্মকর্তাদের তদারকিতে কয়লা তোলার কাজ করেন মূলত দিনাজপুর এলাকার দরিদ্র শ্রমিকেরা। তাঁরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কোনো শ্রম অধিকার ছাড়াই এখানে কাজ করেন। একেকজন শ্রমিক মাসে ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন।
তবে কয়লাখনির কাজ অস্বাস্থ্যকর এবং বেশিদিন এই কাজ করলে শ্রমিকদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।