এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: ১০ মিনিটে আসা যাবে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট
2023.09.01
ঢাকা
ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার পথ ১০ মিনিটে অতিক্রম করবেন শহরের বাসিন্দারা। চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ১৩ বছর পর চীনা দুই কোম্পানি নির্মিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই একাংশ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে শনিবার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানের সড়কটির যান চলাচল উদ্বোধন করবেন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহারে যানবাহন ভেদে ৮০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত টোল দিতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এতে পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল চলাচল থাকবে না।
এই প্রকল্প কিছুটা হলেও ঢাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে বলে শুক্রবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা ছাড়া কেবলমাত্র অবকাঠামো নির্মাণ করে সোয়া দুই কোটি জনসংখ্যার মেগাসিটি ঢাকার যানজট নিরসন হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মুসলেহ উদ্দিন হাসান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে আমাদের অনেকেরই প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু আমার মনে হয়, এর মাধ্যমে যানজট কমার প্রত্যাশা পূরণ না-ও হতে পারে। আবার যে একেবারেই লাভ হবে না সেটিও বলা যাবে না।”
যানজট না কমার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ধরুন, একটি গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট আসতে বর্তমানে ৪৫ মিনিট সময় ব্যয় হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সেই গাড়ি ১০ মিনিটে ফার্মগেটের কাছে চলে আসবে। কিন্তু সেখানে এসে গাড়িটি যখন নিচের রাস্তায় নামতে যাবে, তখনই আটকে যাবে।”
“এর কারণ হলো, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের রাস্তা দিয়েও গাড়ি আসছে। সুতরাং, দুই দিকের গাড়ির প্রবাহের ফলে গতি কমে যাবে, যানজট হবে। হয়তো দেখা যাবে নিচে নামতে না পেরে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর আটকে থাকবে গাড়িগুলো,” বলেন মুসলেহ উদ্দিন।
“যানজট নিরসনের জন্য প্রয়োজন গণপরিবহন ব্যবস্থার সঠিক পরিকল্পনা। …সেটি না করে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করে তেমন লাভ হবে না,” বলেন মুসলেহ উদ্দিন।
“এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে গাড়ি বৃদ্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কী চলাচল করবে? মূলত প্রাইভেট কার ও অন্যান্য বিশেষায়িত যানবাহন। কোনো গণপরিবহন সেখানে থাকবে না। জনগণের জন্য বাস সার্ভিস থাকবে না। সুষ্ঠু গণপরিবহন পরিকল্পনা না করে মহাখালী ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে আমরা দেখেছি যে, শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করে কোনো লাভ নেই। এরপরও আমরা সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করিনি।”
‘পুলিশের মতামত নেওয়া উচিত’
বাংলাদেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিকল্পনা ও অবকাঠামো নির্মাণ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভাগগুলোর হাতে ন্যস্ত। এছাড়া নগর এলাকায় সিটি করপোরেশন রাস্তা সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণ করে থাকে।
অন্যদিকে সড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে পুলিশের হাতে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পুলিশের মতামত গ্রহণ করেন না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন শুক্রবার বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানজট কমার ক্ষেত্রে কিছু অবদান রাখবে, কিন্তু এটি কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে-সেটি হয়তো বলা যাবে না।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ঢাকা শহরের রাস্তার প্রকৃতি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, রাস্তাগুলো মাঝখানে চওড়া কিন্তু মোড় অথবা প্রান্তগুলো সরু। অর্থাৎ বোতলের মতো আকৃতির: পেট মোটা কিন্তু গলা সরু। গাড়িগুলো চওড়া স্থান দিয়ে দ্রুত চলে আসে, সরু প্রান্তে আটকে যায়। তখন ধীরে ধীরে চলতে থাকে। এই বিষয়গুলো পুলিশকে দেখতে হয়।”
তিনি আরও বলেন, “যানবাহন সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পুলিশের মতামত নেওয়া উচিত।”
ঢাকা শহরের যানজট কমাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দক্ষিণে কাওলা-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে সড়ক বিভাগের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে।
অর্থাভাবে কোম্পানিটি কাজ করতে গড়িমসি করতে থাকে। দফায় দফায় সময় বৃদ্ধির পরও কাজ শেষ করতে পারেনি তারা। কাজ শেষ করতে শরণাপন্ন হতে হয় দুই চীনা কোম্পানির।
ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড এই প্রকল্পের ৫১ শতাংশ শেয়ার নিজেদের হাতে রেখে ৩৪ শতাংশ চীনের শ্যানিডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশন গ্রুপকে এবং ১৫ শতাংশ শেয়ার আরেক চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রোকে দিয়ে দেয়।
এই দুই চীনা কোম্পানি মোট ৮৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চীনা সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছে।
২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে দুই চীনা কোম্পানি। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পুরো প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এতে মোট খরচ আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।
এই এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ পাবে কোম্পানিগুলো।