টাকা বকেয়া, কয়লা দিচ্ছে না চীন, বন্ধ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.05.31
ঢাকা
টাকা বকেয়া, কয়লা দিচ্ছে না চীন, বন্ধ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত দেশের বৃহৎ ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফাইল ছবি।
[সৌজন্যে: বিসিপিসিএল]

এক বছর আগে চীনের অর্থায়নে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত ঘোষণা করেছিল সরকার।

বকেয়া পরিশোধ না করায় চীনের কোম্পানি সিএমসি কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শুক্রবার থেকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে বৃহত্তর বরিশাল এবং খুলনা-যশোর অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট হবে।

বকেয়া ৪০ কোটি ডলার পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা যাবে না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় কয়লা কিনতে ডলার সরবরাহ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকট না হলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত সংকটে পড়ত। তাঁদের ভাষ্য, সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে এমন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ২৪ হাজার মেগাওয়াট হলেও দেশের ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।

ফলে চলমান তাপদাহের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে অব্যাহত রয়েছে লোডশেডিং।

আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাসে জানিয়েছে, চলমান তাপদাহ আগামী আরও চার থেকে পাঁচ দিন থাকতে পারে।

টাকা বকেয়া, কয়লা দিচ্ছে না চীন, বন্ধ হচ্ছে উৎপাদন

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হওয়ার পরও কেন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক মো. শামীম হাসান বুধবার বেনারকে বলেন, “এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম পায়রার একটি ইউনিট কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ২ জুন থেকে দ্বিতীয় ইউনিটও বন্ধ হয়ে যাবে।”

“এছাড়া এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও কয়লা অভাবে বন্ধ ছিল। বর্তমানে তারা কিছুটা কয়লা পেয়েছে এবং মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে,” বলেন তিনি।

কয়লা সরবরাহ সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে দিচ্ছে না। ডলার দিচ্ছে না। সে কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানাধীন বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির কাছে কয়লার টাকা বাকি পড়েছে। বকেয়া পরিশোধ না করলে কয়লা সরবরাহকারী কোম্পানি সিএমসি কয়লা দেবে না।”

শামীম বলেন, “বকেয়া পরিশোধের জন্য কোম্পানি ৪০০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে। মজুত যে কয়লা রয়েছে তা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলছে। ২ জুন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলে বৃহত্তর বরিশাল এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেবে।”

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকলেও সরকারকে সক্ষমতা চার্য হিসেবে টাকা দিতে হবে।

“ডলার সংকটসহ প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি সমস্যার সম্মিলিত ফলাফল হলো বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট,” বলেন শামীম।

চলমান তাপপ্রবাহের কারণে মঙ্গলবার দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি ছিল বলে জানান শামীম। তিনি বলেন “এই তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে এই চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাবে।”

তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা উৎপাদন করতে পারছি সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াট। প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি হচ্ছে। সে কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বারবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।”

গত বছরের ২১ মার্চ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভ্রান্তনীতির ফলাফল?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এজাজ হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। কারণ মানুষ বাড়তি সংখ্যক পাখা এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করে।

তবে তাঁর মতে, “বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট কেবলমাত্র তাপপ্রবাহ অথবা ডলার সংকটের কারণেই নয়।”

এর মূল কারণ “সরকারের ভ্রান্ত নীতি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের খাতকে ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য সভরেন গ্যারান্টি দিয়েছে। সরকার বলেছে- তোমরা বিনিয়োগ করো; আমরা তোমাদের বিদ্যুৎ কিনব। না কিনলে ক্যাপাসিটি চার্য দেবো।”

“সরকার বিদ্যুতের চাহিদার একটি বড়ো হিসাব করেছিল কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদা সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। শতভাগ বিদ্যুতায়িত করার ফলে সারা দেশে বাসা-বাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিল্প পর্যায়ে চাহিদার সৃষ্টি হয়নি,” বলেন অধ্যাপক এজাজ।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও বর্তমান চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট মেটানো যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদেরকে বকেয়া ১৮ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। সুতরাং, এখানে শুধু ডলার নয়। টাকারও সংকট আছে।”

অধ্যাপক এজাজ বলেন, “বেসরকারি কোম্পানিগুলো তাদের সব অর্থ এই খাতে ব্যয় করেছে এবং তারা এখন সরকারের কাছ থেকে আর বকেয়া টাকা পাচ্ছে না। এমনকি ব্যাংকগুলোও তাদের ঋণ দিচ্ছে না।”

মূল কারণ ডলার সংকট

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনের মতে, “মূলত ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে।”

তিনি বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি এবং কয়লার দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। সে কারণে বাড়তি দামে আমদানি করতে সরকার দ্বিতীয়বার চিন্তা করছে।”

তবে এই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে দেশে ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ৪৭ ভাগ গ্যাসচালিত, ২৭ ভাগ ফার্নেস ওয়েল ও ১১ ভাগ কয়লা ভিত্তিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।