চীনা ঋণে মোংলা বন্দরের সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ

রিয়াদ হোসেন
2023.09.12
ঢাকা
চীনা ঋণে মোংলা বন্দরের সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ খুলনার মোংলা সমুদ্র বন্দর এলাকায় পশুর নদীতে মাছ ধরছেন দুইজন জেলে। ১ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সোয়া চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের সুবিধা বাড়াতে একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার।

মঙ্গলবার এটিসহ নতুন করে ১৯টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৮ হাজার কোটি টাকা।

সভা শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, “মোংলা বন্দরের সুবিধাদি সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য চীনা ঋণ তিন হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, বাকি ৫০০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।”

তার মানে প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ টাকা আসবে চীনের ঋণ থেকে।

‍“চলতি বছর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এবং শেষ হবে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশ আসে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। খুলনার মোংলা বন্দরের মাধ্যমে মাত্র ৫ শতাংশ বা তার কিছু বেশি আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে।

ফলে বিপুল ব্যয়ের এই নতুন প্রকল্প ভবিষ্যতে দেশের জন্য কতটুকু কাজে দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “এ ঋণ তো ভবিষ্যতে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু এ ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্প ব্যবসা-বাণিজ্যে কতটা ভূমিকা রাখবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।”

“কেননা এতদিনেও সেখানে জাহাজ আসা-যাওয়ায় তেমন গতি আসেনি,” বলেন তিনি।

ব্যবসায়ীরাও সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বিশেষ আগ্রহ দেখান না। এই বন্দর দিয়ে মূলত গাড়ি, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) বেশি আমদানি হয়ে থাকে।

গাড়ি আমদানিকারক ও বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যাল ইম্পোর্টার্স এন্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সভাপতি আব্দুল হক বেনারকে বলেন, “বন্দরটির মাধ্যমে আমদানির ক্ষেত্রে সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম। এ ছাড়া সেখানে বড়ো জাহাজ ভিড়তে পারে না।”

“নতুন করে উন্নয়ন কাজ করা হলেও বড়ো রকমের কিছু হবে (আমদানি-রপ্তানি) বলে মনে হয় না,” বলেন তিনি।

অবশ্য এটি নিয়ে আশাবাদী সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বেনারকে বলেন, “মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। গাড়ি আমদানির বেশিরভাগই হয় মোংলার মাধ্যমে। এলপিজিও আসে এই বন্দরের মাধ্যমে।”

“আগামীতে মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি আরো অনেক বাড়বে,” যোগ করেন তিনি।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপে অনুযায়ী, এর মাধ্যমে প্রশাসনিক ও অন্যান্য অস্থায়ী কাজ, ভূমি উন্নয়ন, নৌ-কাঠামো, বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য কাজ করা হবে।

এর মাধ্যমে আধুনিক বন্দর সুবিধাসহ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বাড়ানো, জেটি নির্মাণ, কন্টেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণসহ আরো কিছু কাজ করা হবে।

এটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির নতুন প্রকল্পের তালিকায় উচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রকল্পটি চীনের ঋণে হলেও তা কী ধরনের ঋণ, এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।

চীনের ঋণে সতর্ক থাকা দরকার

প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশিরভাগ অর্থই চীন থেকে ঋণ পাওয়ায় তা সরকারের উপর বড়ো আর্থিক চাপ তৈরি না করলেও চীনের ঋণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, তাদের সূদের হার কত হবে, কারা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করবে – এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি বলেন, “প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি ঠিকাদার নিয়োগ, কেনাকাটা না করা যায়, তার মানে মূল্য বেশি দিতে হবে।”

সরবরাহ ঋণের ক্ষেত্রে যে দেশ ঋণ দেয় ওই দেশের কোম্পানির কাছ থেকেই সরঞ্জামাদি ক্রয় করতে হয়। 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারত এ ধরনের ঋণে নিজ দেশের কোম্পানি নিয়োগের শর্ত দেয়। কিন্তু চীন নিজ দেশের কোন কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে হবে, তাও ঠিক করে দেয়।

“এ কারণে দুই শতাংশ ঋণের সূদের হার ২০ বছরে পরিশোধ করতে হলেও শেষ পর্যন্ত তা দুই শতাংশ থাকে না” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এর চেয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক সুবিধাজনক।”

এটি সরবরাহ ঋণের আওতায় কিনা, সেই তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি পরিকল্পনা মন্ত্রীও। তিনি বেনারকে বলেন, “চীনের টাকায় সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, আমরা অর্থ পরিশোধ করব। এটি চুক্তির মধ্যে আছে।”

যে কারণে জনপ্রিয়তা পায়নি মোংলা বন্দর

দেশে প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরের একটি মোংলা বন্দর। দীর্ঘদিনেও আমদানি-রপ্তানিতে প্রত্যাশিত গতি আসেনি।

বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, আমদানি-রপ্তানির পাঁচ শতাংশের বেশি হয় এ বন্দরের মাধ্যমে।

আব্দুল হক বলেন, নদীর গভীরতা কম হওয়ায় এই বন্দরে এখনো বড়ো জাহাজ আসতে পারে না। সময় বেশি লাগে, ব্যয়ও বেশি হয়। যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজর জট হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা এ বন্দরের দিকে তেমন একটা আসতে চান না।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি মো. মনির হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা যাদের কাছে পণ্য রপ্তানি করি, তারা মোংলা বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই পণ্য নিতে বেশি আগ্রহী।”

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, এ বন্দর দিয়ে চার বছর আগের তুলনায় জাহাজ আসার পরিমাণ কমেছে।

অবশ্য আট বছর আগের অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছর বিবেচনায় নিলে জাহাজ আসার সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।

তবে আট বছর আগে ২৬ হাজারের বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হলেও তা আট বছর পর এসে ২০ হাজারে নেমেছে। অবশ্য মাঝে কয়েক বছর তা বেশি হয়েছিল।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ক্যাপ্টেন মো. আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এই বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ হয়ে থাকে। এই বন্দরের মাধ্যমে গাড়ি, এলপিজি, প্রকল্পের যন্ত্রপাতি খালাস হয়। মোংলা ইপিজেডের পণ্য এই বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হয়।”

এই বন্দরের আধুনিকায়নে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ড্রেজিং সম্পন্ন হবে আগামী জুনের মধ্যে। সেক্ষেত্রে সাড়ে ১০ মিটার গভীর জাহাজও এ বন্দর দিয়ে আসতে পারবে।”

এসব কাজ সম্পন্ন হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হ্যান্ডলিং সক্ষমতারও বেশি জাহাজ এই বন্দরে আসবে বলে জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের ওই সদস্য।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।