জলবায়ু সম্মেলন: বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব নেতাদের প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বান
2021.04.22
ঢাকা
জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে অবিলম্বে একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বিশ্বের ৪০টি দেশের নেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল লিডারস সামিটে তিনি এই আহ্বান জানান। দুই দিনব্যাপী এই জলবায়ু সম্মেলন শুক্রবার শেষ হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, “১০০ বিলিয়ন (এক হাজার কোটি) মার্কিন ডলার তহবিলের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে হবে, যা অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ৫০:৫০ ভারসাম্য বজায় রাখবে। এই তহবিলের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোর ক্ষয়ক্ষতি পূরণে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুটেরেস সম্মেলনে অংশ নিয়ে বলেন, বিপজ্জনক গ্রিন হাউস গ্যাসের বর্তমান নিঃসরণের মাত্রা গত ত্রিশ লাখ বছরেও দেখা যায়নি। বিশ্বের তাপমাত্রা ইতোমধ্যে এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় বিপর্যয়ের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে বলা যায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, দাবদাহ, সাইক্লোন, দাবানল ও অন্যান্য দুর্যোগের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রায় খাদের কিনারে। এখনই আমাদের সঠিক দিকে হাঁটতে হবে।”
জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার এক টুইটবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ধন্যবাদ জানান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা ৫০ মিনিট থেকে শুরু করে প্রায় চার মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন।
“প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অভিযোজন ও প্রশমনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব স্থানে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন এবং পরিবর্তনশীল জলবায়ু সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশ তার জিডিপির আড়াই ভাগ অর্থাৎ পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে,” জানান প্রেস সচিব।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সম্মেলনটি সরাসরি দেখানো হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে আগত ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকট সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অবিলম্বে একটি উচ্চাভিলাষী কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।”
কার্বনশূন্য ও সবুজ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিতে হবে এবং উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“আমরা দেশব্যাপী ৩০ মিলিয়ন চারা রোপণের পরিকল্পনা করেছি,” জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জলবায়ুর পরিবর্তন সহনীয় টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা বিদ্যমান জ্বালানী, শিল্প ও পরিবহন খাতের পাশাপাশি নতুন খাত অন্তর্ভুক্ত করেছি। এভাবে আমরা কার্বন হ্রাসের পদক্ষেপ নিয়েছি।”
'এই মুহূর্ত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে'
পরিবেশবিদরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি বৃদ্ধি করতে বিশ্ব নেতারা রাজি হলে তা হবে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তিতে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ দুই ডিগ্রি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষে ২০০৬ সাল থেকে সকল জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক।
তিনি বেনারকে বলেন, “উন্নত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের প্রধান দাবি, এই মুহূর্ত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। অন্যথায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই থাকবে।”
“২০০৯ সালে উন্নত বিশ্বের নেতারা ২০২০ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি করেন। সেই অর্থ এখনও দেয়া হয়নি। আমরা চাই এই ১০০ বিলিয়ন ডলার অচিরেই দেয়া হোক,” বলেন জিয়াউল হক।
বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৮ জাতির ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) প্রধান এবং অনুন্নত দেশ (এলডিসি) গ্রুপের নেতা। অভিযোজনের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম সারির দেশ হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ।
বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে জাপানের কিয়োটো শহরে এক সম্মেলনের মাধ্যমে শুরু হয় বিশ্বকে রক্ষার আলোচনা।
১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয় এবং তা ২০১২ সালে শেষ হয়, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় নতুন প্যারিস চুক্তি। অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই বছর দায়িত্ব গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তিতে ফিরিয়ে আনেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে তাঁর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত হিসাবে নিয়োগ করেন তিনি। দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ সফর করে এই সম্মেলেনে যোগ দিতে শেখ হাসিনার কাছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন কেরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর কী কী প্রভাব পড়বে সে ব্যাপারে ২০০৭ সালে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে জাতিসংঘের ইন্টার-গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)।
আইপিসিসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই উচ্চতা ৩২ সেন্টিমিটারে এবং ২১০০ সালে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ৮৮ সেন্টিমিটারে পৌঁছাবে।
এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে, ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়বে, মাটির উর্বরতা কমে যাবে। সাইক্লোন ও উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, সম্মেলনে যে ৪০টি দেশের নেতারা অংশ নিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে মধ্যে ১৮টি দেশই বিশ্বের ৮০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে।
“প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সময় ২০৩০ করার প্রস্তাব করেছেন জো বাইডেন। এই প্রস্তাব হয়তো এই সম্মেলনে গৃহীত হয়ে যাবে। সেটি যদি হয় তাহলে বিশ্বে এটা হবে একটি বিরাট অর্জন,” বলেন ড. আইনুন নিশাত।
বিষয়টা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সহজ করে বলতে গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা শিল্প-যুগের আগের চেয়ে এক দশমিক বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্য হবে। এর ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়বে না।”
এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান করলে সেখান থেকে অর্থ পাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নত প্রযুক্তি পাবে বাংলাদেশ।
তাঁর মতে, “বাংলাদেশ অর্থ পেলেও সেই অর্থ যাচ্ছেতাই ভাবে খরচ করতে পারবে না। সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটিই হবে বড়ো সমস্যা।”
এছাড়া বাংলাদেশের “স্বচ্ছতার সাথে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে,” বলেন ড. আইনুন নিশাত।