বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২৬: বাংলাদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সুবেল রায় ভাণ্ডারী
2021.10.28
কাঠমান্ডু
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২৬: বাংলাদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের আগে ইটালির রাজধানী রোমে ধরিত্রী আকৃতির একটি বেলুন নিয়ে খেলা করছে এক শিশু। ২৯ নভেম্বর ২০১৫।
[রয়টার্স]

আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৩:৩০

জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে ধরিত্রীকে বাঁচাতে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির পর বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৬ (কপ-২৬) রোববার ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে শুরু হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস মহামারির পর এটিই হবে সশরীরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য গ্লাসগো সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড়ো অংশ সাগরে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হবে কোটি মানুষ।

বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী, জলবায়ু গবেষকরা বলছেন, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বর্তমান শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দুই ডিগ্রির নিচে, সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব হলেই কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা যাবে বিশ্বকে।

শুধু সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃদ্ধি পাবে খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, ভূমিধ্বসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেগুলোর অধিকাংশ অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করবে। দেখা দেবে খাদ্যাভাব, রোগবালাইসহ বিভিন্ন দুর্যোগ।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ১৩-দিনব্যাপী এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।

cop3.jpeg
ভোলায় মেঘনা নদীর পানিতে তলিয়ে যাওয়া নিজের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ১৭ নভেম্বর ২০১৫। [এপি]

কয়লা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে

সম্মেলন শুরুর আগেই জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্বন নিঃসরণের যে পরিকল্পনা (এনডিসি) জমা দিয়েছে সেটি অনুযায়ী, বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরিবর্তে দুই দশমিক সাত ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে যা হবে মানবজাতির জন্য সর্বনাশা।

কপ-২৬ এর সভাপতি অলোক শর্মা সম্প্রতি বলেন, “দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ চরম দাবদাহের শিকার হবে। দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে দুইশ কোটিতে।”

তিনি বলেন, “এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখ সারির দেশগুলো এত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের কাছে দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস মানে বেঁচে থাকা।”

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন জার্মানওয়াচ জানিয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন্স ও থাইল্যান্ড সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের শিকার হয়েছে।

প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এক’শ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ শূন্য করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অলোক শর্মা বলেন, বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ অর্থনীতি কার্বন শূন্য লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। এটি কপ-২৬ এর অন্যতম আলোচ্য বিষয় বলে তিনি জানান।

গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম উৎস কয়লা নিয়ে কপে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক জ্বালানী সংস্থা (আইএ) বলছে এশিয়ার দেশগুলো বিশ্বের শতকরা ৭৫ ভাগ কয়লা ব্যবহার করে।

সেপ্টেম্বর মাসে গবেষণা সংস্থা ই৩জি এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত হিসাবে, বিশ্বের বিদ্যমান কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ ভাগের চার ভাগই রয়েছে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও বাংলাদেশে।

২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের এক নম্বর কয়লা রপ্তানিকারক দেশ ছিল। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন বিশ্বের পাঁচ কয়লা আমদানিকারক দেশ বলে জানিয়েছে অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সজিটি।

cop2.jpg
ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার উত্তরে বুলাকান অঞ্চলের উপকূলীয় সিত্তিও পারিহান গ্রামে আংশিক নিমজ্জিত এক গির্জা থেকে বেরিয়ে আসছেন তত্ত্বাবধায়ক ন্যান্সি মানালায়াসা। ২৬ নভেম্বর ২০১৯। রয়টার্স]

ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকবে বাংলাদেশও

গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২১ অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলবায়ুর চরম প্রভাব দেখা গেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট চেঞ্জ সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, গ্লাসগো সম্মেলনে প্রায় ১০০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অধিদপ্তরের আরেক পরিচালক জিয়াউল হক, যিনি ২০০৬ সাল থেকে প্রতিটি কপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি বেনারকে বলেন. “গ্লাসগো সম্মেলনে প্রধান যে বার্তা বাংলাদেশ বিশ্বকে দিতে চায় তা হলো, প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে।”

তিনি বলেন, “বিশ্বে শতকরা ৮০ ভাগ নিঃসরণের জন্য দায়ী জি-২০ দেশগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান, আপনারা ২০৩০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের স্তরের শতকরা ৪৫ ভাগ নিঃসরণ কমাতে হবে।”

জিয়াউল হক বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে শুরু করেছি।”

তিনি বলেন, “আমরা শুধু বিশ্বের উন্নত বিশ্বকেই নিঃসরণ কমাতে আহ্বান জানাচ্ছি না। আমরা নিজেরাও আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এর অংশ হিসাবে আমরা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছি।”

জিয়াউল হক বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের মোট নিঃসরিত কার্বনের শতকরা শূন্য দশমিক পাঁচ ভাগেরও কম নিঃসরণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে সপ্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। আমরা এই ক্ষতির জন্য দায়ী নই।”

বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা দুই ভাগ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। দূষণ কমাতে ২০৬০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানী চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যোগান দেয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে ইন্দোনেশিয়া।

গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২১ অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চতুর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন। ২০১৯ সালে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় এই দেশের অবস্থান ১৭তম।

কার্বন নিঃসরণ কমাতে ফিলিপাইনের কোনো পরিকল্পনা নেই। নতুন করে কোনো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।

ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি রড্রিগো দুতার্তে জলবায়ু সম্মেলনকে ‘আজেবাজে‘ বলে অভিহিত করলেও পরে তিনি তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন।

জার্মানওয়াচের দীর্ঘ মেয়াদি জলবায়ু ঝুঁকির তালিকা-২০২১ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড বিশ্বের ১৯তম দূষণকারী দেশ ছিল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রিয়ুথ চান-ও-চা গ্লাসগো সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন।

থাইল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশমন্ত্রী ভারায়ুত শিল্পা-আর্চ গত সপ্তাহে বলেন, ২০৬৫ সালের মধ্যে থাইল্যান্ড কার্বন শূন্য অর্থনীতি হবে।

কার্বন ব্রিফ অনুযায়ী, ১৮৫০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে জনপ্রতি নিঃসরিত কার্বনের দিক থেকে মালয়েশিয়ার অবস্থান অষ্টম। যার অন্যতম কারণ হলো বনায়ন ধ্বংস করা।

ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট এর মতে, কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে বিশ্বের ২৫টি দেশের একটি মালয়েশিয়া।

কপে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করবেন পরিবেশ ও পানি মন্ত্রণালয়ের প্রধান সচিব জাইনি উজাং।

গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০৫০ সালের আগে তাঁর দেশ কার্বন শূন্য অর্থনীতি হবে না।

তবে তিনি জানান, তাঁর সরকার জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি ও সবুজ প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেবে।

ম্যানিলা থেকে জেসন গুটারেজ, জাকার্তা থেকে আহমদ পাথনি, ব্যাংকক থেকে কুনাউত বুনরিক, ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী, কুয়ালালামপুর থেকে হাদি আজমি ও মুজলিজা মুস্তাফা এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।