টিআইবির জরিপ: ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’

আহম্মদ ফয়েজ
2022.08.31
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
টিআইবির জরিপ: ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’ ঢাকার গাবতলী মোড়ে ছাতা মাথায় দায়িত্ব পালন করছেন দুজন ট্রাফিক পুলিশ। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দুর্নীতি তুলনামূলক বেড়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এই খাত, সেখানে সেবা নিতে গিয়ে ৭৪ শতাংশের বেশি সেবা প্রত্যাশী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।

টিআইবির তথ্যমতে, ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা খাতে দুর্নীতি ছিল সাড়ে ৭২ শতাংশ।

সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দুর্নীতির এই তথ্য। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষক ফারহানা রহমান গবেষণার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন।

এতে দেখা যায়, ২০২১ সালে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সাত খাতের মধ্যে রয়েছে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৪ শতাংশ), পাসপোর্ট (৭০.৫ শতাংশ), বিআরটিএ (৬৮.৩ শতাংশ) বিচারিক সেবা (৫৬.৮ শতাংশ), স্বাস্থ্যসেবা (৪৮.৭ শতাংশ), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৪৬.৬ শতাংশ) এবং ভূমি সেবা (৪৬.৩ শতাংশ)।

অন্যদিকে ২০২১ সালে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৪০ শতাংশের বেশি। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী তিনটি খাত হচ্ছে; পাসপোর্ট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বিআরটিএ। এই বছরে সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়ের তিনটি খাত হলো; বীমা, বিচারিক ও গ্যাস সেবা।

জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

সেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি পরিচালিত নবম খানা জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ এটি।

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত ৬৪ জেলায় এই জরিপ পরিচালিত হয় বলে জানিয়েছে টিআইবি। জরিপে নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবা গ্রহণের সময় যে সকল দুর্নীতি ও হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়

ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’

টিআইবির জরিপ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বেনারকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার শূন্য সহিষ্ণু নীতি গ্রহণ করেছে।

অনেক সংস্থা আছে সরকারকে বিব্রত করতে নানা রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টিআইবি যে জরিপ করেছে তা আমাদের সাথে শেয়ার করলে কিছু করণীয় থাকলে সরকার অবশ্যই তা করবে,” বলেন তিনি।

এ সময় সেবা খাতে দুর্নীতিতে কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সার্বিক তথ্য উদ্বেগজনক দাবি করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিচারিক খাতের দুর্নীতিও উদ্বেগজনক। যারা অনিয়ম করছেন, তারা ঘুষকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। যারা দিচ্ছেন তারা জীবনযাপনের অংশ করে নিয়েছেন।”

জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭২.১ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’- বলে জানিয়েছেন।

পরিবারপ্রতি ঘুষ ৬৬৩৬ টাকা

টিআইবির জরিপে জানা গেছে, সার্বিকভাবে খানা প্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। ২০২১ সালে সার্বিকভাবে উত্তরদাতাদের ৭০.৯ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, যা ২০১৭ সালে ছিল ৬৬.৫ শতাংশ। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।

যদিও দুর্নীতির ফলে সকল শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে প্রতিবন্ধী, গ্রামাঞ্চলের ও নিম্ন আয়ের খানা অর্থাৎ প্রান্তিক জনগণের ওপর এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

সরকারি কর্মকর্তাদেরকেও উল্লেখযোগ্য হারে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা তারা চাকুরিরত কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশি হারে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

বেড়েছে দুর্নীতির মাত্রা

জরিপের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের হার কমেছে কিন্তু ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে।

অপরদিকে অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে সেবা খাতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিভিন্ন খাতে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কোনো কোনো সেবা খাতে তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি একই অবস্থায় রয়েছে (যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ ইত্যাদি) এবং কিছু খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিমা ইত্যাদি)।

এছাড়া, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কোনো কোনো খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বেড়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং কোনো কোনো খাতে কমেছে (কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা)।

জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য টিআইবির সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সেবাগ্রহীতার সাথে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সকল সেবা ডিজিটালাইজড করা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে।

দুর্নীতি কমাতে কাজ করছে দুদক

টিআইবির প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার মো. জহুরুল হক বেনারকে বলেন, “সেবা খাতের দুর্নীতি লাঘবে দুদক নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে।”

তিনি বলেন, টিআইবি যেভাবে সেবা খাত নিয়ে অভিযোগ করেছে তা ধরে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দুদকের পক্ষে সম্ভব নয়, বরং কোনো দুর্নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার আলোকে আইনি পদক্ষেপ নেবে দুদক।

জরিপে উঠে আসা সেবা খাতের দুর্নীতির চিত্রকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যায়িত করে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এসব হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে।”

তাঁর মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও অন্যান্য খাতগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই ‘চরম দুর্নীতিগ্রস্ত’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।