বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের তথ্য প্রকাশ, বরখাস্ত দুই সরকারি কর্মকর্তা
2023.07.21
ঢাকা
কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাহীন একদল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপক বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতকে মূলত চীনা ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার বিষয়টি ‘লুটেরা মডেল’ হয়ে উঠেছে।
সরকারের এক প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উল্লেখ করার পর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন দুজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত শুরু করেছে সরকার।
তাঁদের তৈরি ওই প্রতিবেদনে ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৯০ হাজার কোটি টাকা অপচয়ে উল্লেখ করা হয়। আরো বলা হয়, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার যে বিপুল টাকা (১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি) লোকসান করেছে, শুধু আগামী দুই বছরে তার চেয়ে বেশি লোকসান করবে।
বিদ্যুৎখাতে এই লোকসান বাড়াতে বর্তমান সরকারের প্রণয়ন করা দায়মুক্তি আইনের ভূমিকা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জন্য সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ ছিল। ‘বিদ্যুৎ সেক্টরভুক্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন’ শিরোনামে এটি গত ২৫ মে আইএমইডির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদনের ক্যাপাসিটি চার্জ, দায়মুক্তি আইন নিয়ে সমালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশ হলে ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তা সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়। তবে এটি সরানোর কারণ জানানো হয়নি। মূল প্রতিবেদনটির একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনের আলোকে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর গত ১৬ ও ১৭ জুলাই এর প্রস্তুতকারক আইএমইডির পরিচালক (উপসচিব) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান ও উপদেষ্টা আইএমইডির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এস এম হামিদুল হককে দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে সরকার। এরপর গত ১৮ জুলাই ও ২০ জুলাই দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাঁদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অসদাচরণের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে এই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নান বেনারকে বলেন, “কিছু ব্যত্যয় হয়েছিল বলেই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই বিষয়টি আরো বিশদভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
কিন্তু প্রতিবেদনে ওঠে আসা বিষয়গুলোকে সরকার আমলে নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি পরিকল্পনামন্ত্রী।
‘লুটপাট সরকারের গোচরেই হচ্ছে’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, প্রতিবেদনে যে অসঙ্গতিগুলো উঠে এসেছে তা এই খাতের একজন পর্যবেক্ষক হিসেব তাঁর কাছে নতুন নয়, খুবই সত্য ঘটনা।
“এখন সরকার এই কর্মকর্তাদের শাস্তি দিয়ে প্রমাণ করল সরকার কোনো প্রকার সমালোচনা নয়, শুধুই প্রশংসা শুনতে চায়। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত যে বিদ্যুৎ খাতের এই লুটপাট সরকারের গোচরেই হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট, গত ১৯ এপ্রিল সবচেয়ে বেশি ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল।
আইএমএফের কাছে উপস্থাপন করা তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির জ্বালানি ব্যয় দাঁড়াবে ৫৫ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ২২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় হবে ৯৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জ ‘লুটেরা মডেল’
ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনটিতে বর্তমান সরকারের ১৪ বছরকে বিবেচনায় নিয়ে বলা হয়েছে, এই সময়ে ৯০ হাজার কোটি টাকা ‘ডলারে’ গচ্ছা গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে।
উল্লেখ্য, এখন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়ে থাকে, যা অপচয় আখ্যা দিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সরকারের সমালোচনা করে আসছেন। যদিও সরকার বলছে, ক্যাপাসিটি চার্জ না দিলে কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে না।
এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, “ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না বিদ্যুৎখাতে, এমন মিথ্যা থামাতে হবে।”
এতে বলা হয়, বেসরকারি উৎপাদনকারীরা স্থানভেদে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বর্ধিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবেন এবং সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে ন্যূনতম এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে-এই দুটি নিশ্চয়তা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে সহজ ব্যাংক ঋণের বিষয়টি থাকবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, “ক্যাপাসিটি চার্জ ‘লুটেরা মডেল’। স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ওভারহোলিং চার্জ। অর্থাৎ যতটুকু সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদনে থাকতে পারবে না (সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ), সেসময়ের জন্যও একটা চার্জ দেওয়া, যাতে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত হয়। কিন্তু মাসের পর মাস উৎপাদনে অক্ষম, অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া বাজেট ড্রেনিং অপচুক্তি।”
ডলারে পেমেন্ট করা বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চুক্তিকে বিদ্যুৎখাতের প্রধানতম সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ডলার নয় বরং টাকায় পেমেন্ট দিতে হবে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশীয়, তাদেরকে ফরেন কারেন্সি পেমেন্ট দেওয়া অযৌক্তিক।”
এতে আরো বলা হয়, ইউনিট প্রতি উচ্চমূল্য, ক্যাপাসিটি ও ওভারহোলিং চার্জ, স্বল্পমূল্যে জ্বালানি ও জমি, সহজ ব্যাংক ঋণ, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা ইত্যাদি ‘বাজেট ড্রেনিং’ গ্যারান্টি বন্ধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের তহবিল সংকটের সমাধান পাওয়া যাবে না।
১২ বছরের তুলনায় ২ বছর বেশি লোকসান
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে, গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। বিপরীতে চলমান ও আগামী এই ২ অর্থবছরেই পিডিবি লোকসান গুনবে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, শুধুমাত্র আগামী দুই বছরেই তার চেয়ে বেশি লোকসান করবে।
লোকসান বাড়াচ্ছে দায়মুক্তি আইন
ক্যাপাসিটি চার্জ ও জ্বালানি আমদানি মূল্য মূলত ডলারে পেমেন্ট করায় ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয় বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০১০ সালে 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি' নামক বিশেষ আইন করেছে সরকার। আইনটির বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।”
আইনটির ৯ ধারা অনুযায়ী ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনে অধীনে সাধারণ বা বিশেষ আদেশে দায়িত্ব পালন করলে তা সরল বিশ্বাসে করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না।
আইনটি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, “দায়মুক্তি আইনের বলে বিদ্যুৎ খাতের ইউনিট প্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট প্রতি বাৎসরিক গড় মূল্য ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। ডলারে পেমেন্ট করা হয় বলে এতে পিডিবির লোকসান থামানো যাচ্ছে না। এই দুর্বৃত্তায়ন থামানো জরুরি।”
সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কয়েক ডজন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা ৩০ শতাংশের কম, অর্থাৎ অনেক বেশি জ্বালানি পুড়লেও ওগুলো খুব কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
ক্যাপটিভের কয়েক হাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বড়ো সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
“সার্টিফিকেট ওরিজিন নকল করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিদেশ থেকে আনা মেয়াদোত্তীর্ণ ও চরম জ্বালানি অদক্ষ এসব প্ল্যান্ট বিদ্যুৎখাতের গলার ফাঁস। দেশে লোডশেডিং যত বাড়বে, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র তত বেশি চলবে। আর ততই জ্বালানি অপচয়ের সমস্যাও প্রকট হবে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
দুর্নীতিবান্ধব ক্রয় প্রক্রিয়ার সুবিধা পাচ্ছে চীন-ভারত
প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতিবান্ধব ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব করে বলা হয়, “কারিগরি জ্ঞানহীন, অভিজ্ঞতাহীন একদল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপক (মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটি, সিপিটিইউ) সরকারের ক্রয়নীতির (পিপিএ/পিপিআর) দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতকে মূলত চীনা ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে।”
উন্মুক্ত দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার নাম করে, বিদ্যুৎখাতে যাবতীয় নিম্নমান যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, নিশ্চয়তাহীন মেশিন ঢুকে গেছে দাবি করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “খুচরা যন্ত্রাংশ ও সাপোর্ট সিস্টেমের নামে ব্যালেন্স অব প্ল্যান্ট (বিওপি) খাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে শত কোটি ডলার, বিওপি বিদ্যুৎ বাজেট অপচয়ের আরেকটা বড়ো খাত।”
দুষ্টের পালন শিষ্টের দমনে সরকার: বিশেষজ্ঞ
প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের নানা অনিয়ম তুলে আনা কর্মকর্তাদের প্রশংসা না করে শাস্তির দিকে ঠেলে দেয়ার বিষয়টিকে সরকারের ‘দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন’ নীতি বলছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ হলে দেশের প্রশাসন এবং যাবতীয় ব্যবস্থা এখন একটি দুর্নীতি সহায়ক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”