বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য লজ্জাজনক
2024.05.21
ঢাকা

গুরুতর দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য বিরাট লজ্জার বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাঁরা কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন।
তবে এ ব্যাপারে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “এটি সেনাবাহিনীর বিষয়, আমি এ মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না।”
মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করছি।”
আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জনসমক্ষে আনার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
উল্লেখ্য, সোমবার দিবাগত রাতে (বাংলাদেশ সময়) মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়।
জেনারেল আজিজের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করতে ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
দেশের জন্য লজ্জা, ব্যবস্থা নেওয়া উচিত
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহিনীর শীর্ষ পদে থাকা কারো দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সত্যিই দেশের মানুষের জন্য লজ্জার বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
“এখন বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে এখানেও আইনের শাসন আছে। তাই ব্যক্তি পরিচয় বা পদগত অবস্থান বিবেচনা না করে নির্মোহ তদন্তের মাধ্যমে এসব দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে,” বলেন তিনি।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধানের প্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য “বিশাল অপমানজনক ঘটনা” বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “আজিজসহ যেসব ব্যক্তিরা বাংলাদেশের জন্য এমন একটি অপমানজনক অধ্যায় রচনা করেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের; বিশেষত দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত অনতিবিলম্বে তাঁদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।”
তাঁর মতে, দীর্ঘ দিনের “রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে” জেনারেল আজিজ ও তাঁর ভাইরা নিজেদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা পৃথিবীর বড়ো বড়ো “মাফিয়া চক্রের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।”
আজিজ আহমেদ ‘উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন’
সাবেক সেনাপ্রধান ও তাঁর পরিবার সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে সোমবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ডে “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।”
“আজিজ আহমেদ তাঁর ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন। এটি করতে গিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অন্যায়ভাবে সেনাবাহিনীর কাজ পাওয়া নিশ্চিত করতে তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন,” বলা হয় বিবৃতিতে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় জেনারেল আজিজ ও তাঁর পরিবারের কিছু সদস্যের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার ঘটনা উন্মোচন করে “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন” নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়। এতে আজিজের পরিবারের সদস্যদের অতীত ও তৎকালীন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
জেনারেল আজিজ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তথ্যচিত্র নির্মাতারা সেনাপ্রধান ও তাঁর তিন ভাইয়ের ওপর নজর রাখছিলেন।
২০০৪ সালে আজিজের তিন ভাইকে একটি হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাঁদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন। আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদ এখনো পলাতক, কিন্তু তথ্যচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে আজিজের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে তথ্যচিত্রটিতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ “মিথ্যা ও বানোয়াট” বলে তখন দাবি করেছিলেন জেনারেল আজিজ।
নিষেধাজ্ঞা শুনে ‘অবাক’ জেনারেল আজিজ
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে মঙ্গলবার ঢাকায় নিজের বাসভবনে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জেনারেল আজিজ।
বেসরকারি টেলিভিশন যমুনায় প্রচারিত সাক্ষাৎকারে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “এটা শুনে আমি অবাক হয়েছি।”
আল জাজিরায় প্রকাশিত তথ্যচিত্রটিকে ‘নাটক’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞায় তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই একই বিষয় ওই তথ্যচিত্রে ছিল।
ভাইকে বিদেশে যেতে সহযোগিতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার সেই ভাই অনেক আগে থেকেই বিদেশে থাকে। সে বৈধ পাসপোর্ট নিয়েই বিদেশ গিয়েছে। এখানে আমার পদ-পদবি ব্যবহারের অভিযোগ আমি মেনে নিতে পারছি না, এটা সঠিক না।”
ভাইকে সেনাবাহিনীর কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে আজিজ বলেন, “চার বছর বিজিবি প্রধান এবং তিন বছর সেনাপ্রধান থাকাকালে আমি আমার কোনো ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবিতে বা সেনাবাহিনীতে কোনো কন্ট্রাক্ট দিয়েছি—সে প্রমাণ কেউ দিতে পারলে আমি যে কোনো পরিণতি মেনে নিতে প্রস্তুত।”
দুর্নীতির কোনো প্রমাণ না থাকলে কেন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জানতে চাইলে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না। কারণ আমার কাছে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই।”