এক রাতে ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ৫০ সদস্য গ্রেপ্তার

আহম্মদ ফয়েজ
2024.02.21
ঢাকা
এক রাতে ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ৫০ সদস্য গ্রেপ্তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় মঙ্গলবার রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ থেকে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার বিভিন্ন কিশোর গ্যাং এর কয়েকজন সদস্য। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
[সৌজন্যে: র‍্যাব]

ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে বারবার উঠে আসছে কিশোর গ্যাংয়ের নাম। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এই সংস্কৃতি। সম্প্রতি দেশজুড়ে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।

বিভিন্ন সময় কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অস্ত্র-শস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে গ্যাং কালচার বন্ধে ‘অলআউট অ্যাকশন’ চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মঙ্গলবার রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি কথিত কিশোর গ্যাংয়ের ৫০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তাঁদের কাছে বিভিন্ন অস্ত্র পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সময় আমরা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, মূলত আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ নিজ এলাকায় তারা গ্যাং গড়ে তোলে। পরবর্তীতে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে শক্তিশালী হয়।”

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি।

মঈন বলেন, “গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে র‍্যাব কিশোর গ্যাংয়ের ৩৪৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে, অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।”

ঢাকার বাইরেও বাড়ছে গ্যাং কালচার

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষার্থী নীরব হোসেনকে (১৭) ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

কাছাকাছি সময়ে কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে স্থানীয় যুবক মিলন হোসেনের (২৭) নয় টুকরা মরদেহ উদ্ধারের পর তদন্তে নেমে পুলিশ জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এস কে সজীবকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, তিনি কুষ্টিয়ার একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা।

এই দুটি ঘটনার পর দেশজুড়ে আবারও আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক কিশোর গ্যাং নিয়ে জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বক্তব্য রাখেন।

কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, ২০২৩ সালে ২৫টি খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাং জড়িত। বাহিনী বেশি মিরপুর, ডেমরা ও সূত্রাপুর এলাকায়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল ও খুনে সম্পৃক্ত হচ্ছে এসব গ্যাং।

“এদের কারণে ঢাকা শহরে এখন সাধারণ মানুষের বসবাস করা কঠিন,” যোগ করেন তিনি।

মঙ্গলবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন।

অলআউট অ্যাকশন’

খুরশীদ বলেন, “আমাদের মূল কাজ হচ্ছে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিশোর গ্যাংকে কেউ না কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। আমরা চেষ্টা করছি কিশোর গ্যাংকে সমূল কীভাবে বিনাশ করা যায়।”

র‍্যাবের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার গ্রেপ্তার কিশোর গ্যাংয়ের ৩৪৯ সদস্য বিভিন্ন গ্রুপের হয়ে কাজ করতেন।

তাঁদের কাছ থেকে লাঠি, ছুরি, চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল ও ইলেকট্রিক শক মেশিন উদ্ধার করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

দেশজুড়ে সক্রিয় ১৭৩ কিশোর গ্যাং

বাংলাদেশ পুলিশের হিসাব অনুসারে, দেশজুড়ে ১৭৩টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্যাংয়ের মোট সদস্য সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি প্রতিবেদন বেনারের হাতে এসেছে। যাতে উল্লেখ রয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের ৮৯৬ সদস্যের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৭৮০টি মামলা রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় দেশের সর্বোচ্চ ৬৬টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। বন্দরনগরীতে সক্রিয় ৫৭টি কিশোর গ্যাং।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, “আমাদের মহাপরিচালক স্পষ্টই বলেছেন যে, আমাদের অবস্থান কঠোর। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত কেউই ছাড় পাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।”

যেসব কারণে বিস্তার বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের

সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ও তাঁদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বেনারকে বলেন, “কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এসব পরিবারের কিশোর বা তরুণ সদস্যদের আর্থিক অনটনের সুযোগ নেওয়া সহজ। এই সুযোগটা সমাজের অপরাধী চক্রগুলো নিয়ে আসছে।”

তিনি বলেন, “এমন বয়সের কিশোরদের টার্গেট করা হয়, যাদের সাধারণ আইনে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। বরং বয়স বিবেচনায় সহজ আইনের মুখোমুখি হতে হয়। আর এদের কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব বেনারকে বলেন, “কিশোর বয়সে নানা রকম ফ্যান্টাসি থাকে। ফলে এই বয়সে তাদের ভুল পথে নেওয়া তুলনামূলক সহজ হয়।”

সাকিব আরও বলেন, “যেহেতু বড়দের মতো অপরাধ বিবেচনায় নেওয়া হয় না, তাই ক্ষমতাবানরা এটা বিশাল সুযোগ হিসেবে নেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।