ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর ঘটনায় বিচার মেলে না
2024.06.26
ঢাকা
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ইমতিয়াজ হাসান বুলবুল গত বছরের ডিসেম্বরে কারাগারে মারা যান।
নিজের নিরাপত্তাজনিত কারণে বুলবুলের পরিবারের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বেনারকে বলেন, “বুলবুলের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার তদন্ত করেনি। আমরা কোনো বিচারও পাইনি।”
নাটোরের বিএনপি নেতা এ কে আজাদ সোহেলও গত বছরের ডিসেম্বরে মারা যান রাজশাহী কারাগারে। সোহেলকে ওই বছরের ১৮ নভেম্বর পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় বলে বেনারকে জানান তাঁর বড়ো ভাই শামীম রেজা।
“গ্রেপ্তারের সময় আমার ভাই পুরোপুরি সুস্থ ছিল। অথচ ৩০ নভেম্বর তাঁকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমার ভাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হত্যার শিকার হলো,” বলেন রেজা।
সুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তারের পর নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে অথবা কারাগারে মৃত্যু হলেও এসব ঘটনায় সাধারণত বিচার পান না নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো।
এসব পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তও হয় না।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন মতে ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে কারাগারের বাইরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন ১৩৮ জন।
এছাড়া মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে অনুসারে, একই সময়ে জেল হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে আরও ৯২৩ জনের।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৩৮ জনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস উপলক্ষে বুধবার এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, জাতিসংঘের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনে (ক্যাট) ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
২০১৩ সালে নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি আইন প্রণয়ন করে কিন্তু তখন থেকে শুধুমাত্র একটি ঘটনায় বিচার হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তারপরবর্তী সময়ে কারা হেফাজতে কমপক্ষে ১৩ বিএনপি নেতা-কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই ১৩ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর মধ্যে রয়েছেন এ কে আজাদ সোহেল ও ইমতিয়াজ হাসান বুলবুল।
অভিযোগ অস্বীকার সরকারের
নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন বা কারাগারে নির্যাতনে মৃত্যুর বিষয়ে অধিকাংশ অভিযোগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই ধরনের অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।”
তিনি বলেন, “কারাগারে বা হেফাজতে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত হয়, কারও কোনো দোষ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
কারা হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ সম্পর্কে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। দেশের প্রতিটি কারাগারেই জেল কোড অনুযায়ী হাজতি ও কয়েদিদের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।”
দায়মুক্তির অবসান ঘটানোর দাবি
বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্যাতন বর্জন, নির্যাতনকারীদের জবাবদিহি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গবেষক তাকবীর হুদা বলেন, “নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহার কখনই ন্যায়সঙ্গত নয়। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে ব্যাপক ও ক্রমাগত নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহারের অভিযোগগুলোর যেন পুঙ্খানুপুঙ্খ, নিরপেক্ষভাবে ও স্বাধীন তদন্ত হয়।”
সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানান তিনি। নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে তাকবীর আরও বলেন, “দায়মুক্তির এই প্রবণতা খুবই উদ্বেগজনক।”
‘সরকার দায় এড়াতে পারে না’
হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনায় সরকার দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, মানবাধিকার বোধ সঞ্চারের ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ দেখা যায় না।
“বিভিন্ন ঘটনায় সরকারের আচরণ দেখলে মনে হয়, মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকারের উচিত শুধু অবকাঠামো উন্নয়নে নয়—মানবাধিকার বোধ উন্নয়নে উদ্যোগী হওয়া,” বলেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বেনারকে বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দিরা নির্যাতন ও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন, এটি খুবই হতাশাজনক ব্যাপার।
তিনি বলেন, “নিরাপত্তা হেফাজতে ও কারাগারে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন এবং এসব ঘটনায় সরকার কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ছাড়াও দেশি-বিদেশি ১২টি অধিকার গোষ্ঠী বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি করতে এবং ভিকটিমদের ন্যায়বিচারের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এক বিজ্ঞপ্তিতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে।