তিন সপ্তায় বন্দি অবস্থায় চার বিএনপি নেতার মৃত্যু
2023.12.08
ঢাকা
সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে বন্দি চারজনসহ দলের অন্তত ১৮ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গুলি করে, রাতের বেলা অভিযানের সময় নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারের পর কারাগারে নির্যাতন করে নেতাকর্মীদের মেরে ফেলার ঘটনা বেড়েই চলছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজশাহী কারাগারে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাটোরের বিএনপি নেতা এ কে আজাদ সোহেল মারা গেছেন।
সোহেল নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়ানদহ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সোহেলের বড়ো ভাই শামীম রেজা বেনারকে বলেন, নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় সোহেলকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
“সোহেল কারাগারে থাকা অবস্থায় গত ৩০ নভেম্বর নাটোর আদালত থেকে জামিন পান। আদালতের আদেশ নিয়ে কারাগারে গিয়ে জানতে পারি আমার ভাই সেখানে নেই। জেল থেকে আমাদের বলা হয়, তাকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে, সে গুরুতর অসুস্থ। অথচ আমার ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল,” বলেন শামীম।
আটদিন রাজশাহী মেডিকেলে থেকে সোহেল বৃহস্পতিবার মারা যান জানিয়ে তিনি বলেন, “জামিন হলেও আমার ভাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারিনি, সে পৃথিবী থেকেই চলে গেছে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোর জেলা কারাগারের জেলার মো. মোশফিকুর রহমান বেনারকে বলেন, সোহেল ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্ট্রোক করলে প্রথমে নাটোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তাররা তাঁকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠান।
এর আগে গত ১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান হিরা খান (৪৫) মারা যান।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাপুর রহমান (৬৩) মারা যান তার আগে ২৭ নভেম্বর । তিনি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে এসে গ্রেপ্তার হন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জ্যেষ্ঠ জেল সুপার আমিরুল ইসলাম বেনারকে জানান, ২৭ নভেম্বর সকালে গোলাপের বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির অভিযোগ, ২৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ওয়ারী থানাধীন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায় পুলিশ। ৩০ নভেম্বর অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

কারাগারে কাউকে নির্যাতন করা হয় না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে জানান, গত ২৮ অক্টোবর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে “নানা রকম নির্যাতনে।” এর মধ্যে একজন বিএনপি নেতার স্ত্রীও রয়েছেন।
তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে “কয়েকজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে পুলিশের অভিযানের পর, কয়েকজন কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন।”
নানামুখী নির্যাতনের কারণে কারাগারে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা চরম মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তবে “কারাগারে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয় না,” দাবি করে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। যারা অসুস্থ হয় তাদেরকে যথাযথ নিয়ম মেনেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।”
তিনি বলেন, “শুধু রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য বিএনপি নানা রকম অভিযোগ করে থাকে।”
এদিকে শুক্রবার বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৪৯০ জনের বেশি বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এ সময়কালে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৭৮টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৬৬’র বিপরীতে মোট বন্দির সংখ্যা ৭৭ হাজার ২০৩ বলে গত সেপ্টেম্বর সংসদে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি আয়োজিত মহাসমাবেশের এক পর্যায়ে দলটির কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। পরবর্তীতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলার মুখে মাঝপথেই থেমে যায় সমাবেশ। বিএনপির বিরুদ্ধে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
এই ঘটনার জের ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়।
বিরোধী নেতাদের জেলে রেখে এবং বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়েই আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
‘খুবই উদ্বেগজনক’
সরকারের চলমান ক্র্যাকডাউনের মধ্যে বিপুল সংখ্যক বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বন্দি অবস্থায় চার বিএনপি নেতার মৃত্যু “খুবই উদ্বেগজনক,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
তিনি বলেন, “কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের সঠিক চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। সরকার এসব মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না।”
“বিরোধীদের জেলে রেখে সরকার শুধু নির্বাচন সেরে ফেলতে চাইছে তাই নয়, চরম দমন পীড়নের মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে,” বলেন ফারুখ ফয়সল।
কারাগারে এই চার মৃত্যু ছাড়াও ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন ও এর পর গুলিবিদ্ধ হয়ে বা অন্যান্যভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ১৪ নেতাকর্মী।
তাঁরা হচ্ছেন; যুবদল নেতা শামীম, সাবেক যুবদল নেতা আবদুর রশিদ, ছাত্রদল নেতা রেফায়েত উল্লাহ, কৃষকদল নেতা মোঃ বিল্লাল মিয়া, যুবদল নেতা দিলু আহমদ জিলু, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জাকির হোসেন, মোঃ আশিক মিয়া, বিপ্লব হাসান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মোঃ রিয়াজ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মোঃ স্বপন, বিএনপি নেতা কামাল আহমেদ, বিএনপি নেতা আব্দুল মতিন এবং যুবদল নেতা ফোরকান আলী।