উপকূল অতিক্রম করছে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2023.10.24
ঢাকা ও কক্সবাজার
উপকূল অতিক্রম করছে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে জেটি ঘাটে সর্তক সংকেতের পতাকা টাঙিয়ে দিচ্ছেন একজন স্বেচ্ছাসেবী। ২৪ অক্টোবর ২০২৩।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় হামুন কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে।

“ঘূর্ণিঝড় হামুন উপকূল অতিক্রমে কক্সবাজারে আঘাত এনেছে,” জানিয়ে জেলা প্রশাসক শাহীন মুহাম্মদ ইমরান বলেন, “এই মুহূর্ত পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলা যাচ্ছে না ।'

ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় মঙ্গলবার রাতে দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলার ১৫ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেবার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় আতঙ্কে রয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজার ও আশপাশের অঞ্চলে দমকা হাওয়া ও বজ্রবৃষ্টি হচ্ছে এবং সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

তাঁরা জানান, ঝড়ে কক্সবাজারের পাহাড়তলিতে দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক (৩৮) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া মেরিন ড্রাইভের গাছ ভেঙে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

পাঁচ মাস আগে ‘মোখা’ আঘাত হানার পর বাংলাদেশর উপকূলে দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’।

সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম হামুন দেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে আঘাত হানার প্রবল সম্ভাবনা থাকায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাত নম্বর বিপদ সঙ্কেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সতর্কতা হিসেবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এবং সাগরে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিন অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি প্রবল ঘূর্ণিঝড় থেকে কিছুটা দুর্বল হয়ে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।  এটি বাংলাদেশের উপকূলের ১৮০ থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।  ঝড়টি মঙ্গলবার রাতের মধ্যে বাংলাদেশের ভূখণ্ড অতিক্রম করে যেতে পারে।  ফলে সারা রাত দেশের উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টি হতে পারে।  উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বজলুর রশীদ মঙ্গলবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে বেনারকে জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটা থেকে তিনটার মধ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে কুতুবদিয়ায় হামুন বাংলাদেশে আঘাত করতে পারে।

তিনি বলেন, বর্তমানে হামুন চট্টগ্রাম থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ৯০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে সোমবার রাত থেকে কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে।

আগামীকাল বুধবার কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলসহ সারা দেশে ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস।

কক্সবাজারে অবস্থানকারী পর্যটকদের সাগরে নামতে নিষেধ করে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন।

325afb3a-d199-471f-a52f-8e9fd22e6535.jpg
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘হামুনের’ প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সৈকত থেকে উঠে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। ২৪ অক্টোবর ২০২৩। [আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

আতঙ্কে রোহিঙ্গারা

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মাস্টার শফি উল্লাহ রাত আটটার দিকে বেনারকে বলেন, “সন্ধ্যার দিকে বাতাস একটু বেশি মনে হয়েছিল।  এখন ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।  রোহিঙ্গারা এখনও বাড়িতেই আছেন।”

তিনি বলেন, “পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।  তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে সবার মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।”

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মো. জুবায়ের বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে পরিস্থিতি ভালো। তবে রাতে ঝড় বাতাস বাড়বে কিনা জানি না।  মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করছে।”

কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির।  ছোট একটি এলাকায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা গাদাগাদি করে পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা ঘরে বসবাস করেন। সামান্য ঝড়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরগুলো।

তবে তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া না হলেও তাঁদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ক্যাম্পের ভেতরে সিআইসি কার্যালয়, পাকা স্থাপনাগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।  পরিস্থিতি খারাপ হলেই তাঁরা সেখানে চলে যাবে।

“এছাড়াও সবাইকে সতর্ক করতে আজ মাইকিং করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,” বলেন মিজানুর রহমান।

তবে নোয়াখালী জেলাধীন ভাসানচর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো প্রভাব নেই বলে বেনারকে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবিরের ১০ নম্বর ব্লকের মো. হাসান রাত সোয়া আটটার দিকে বেনারকে বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব খুব একটা ভাসানচরে নেই।  সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও হালকা বাতাস ছিল।  এই মুহূর্তে পরিস্থিতি ভালো।”

রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক নেই বলেও জানান তিনি।

উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানে ঝড়-তুফানের কোনো লক্ষণ নেই।  বৃষ্টি নাই, বাতাস নেই; সব স্বাভাবিক আছে।”

তিনি বলেন, “তবে, সরকারের আদেশে কোনো নৌকা অথবা ট্রলার পানিতে নামেনি।”

ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলীয় কৃষি

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক অনিল চন্দ্র সরকার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এখন খেতে রোপা আমন রয়েছে।

তিনি বলেন, ঝড় যদি বেশি মাত্রায় হয় সেক্ষেত্রে ধানের শীষগুলো ভেঙ্গে যাবে এবং ভেঙ্গে গেলে ধান চিটা হয়ে যাবে, ভেতরে দানা হবে না।  এছাড়া লবণ পানি খেতে প্রবেশ করলে ধান পচে যাবে।

অনিল চন্দ্র সরকার বলেন, “বর্তমানে মাঠে শীতের সবজি রয়েছে। এগুলো স্থানীয় মানুষের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।  এই ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকায় শীতের সবজি উৎপাদন ব্যাহত করবে।  ফলে সবজির দাম বেড়ে যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “সবজি উৎপাদন কম হলে তা সার্বিকভাবে দেশের জাতীয় পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।  কারণ অনেক দরিদ্র মানুষ বেশি দামে সবজি কিনতে পারবেন না।”

হামুন হচ্ছে এক বছরের মধ্যে তৃতীয় ঘূর্ণিঝড়। গত বছর অক্টোবরে সিত্রাং আঘাত হানে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।