ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে মারা গেছেন অন্তত ২৪, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.10.25
ঢাকা
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে মারা গেছেন অন্তত ২৪, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ভেঙে পড়া ভিটা থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছেন বাসিন্দারা। ২৫ অক্টোবর ২০২২।
[এএফপি]

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুধবার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

সোমবার রাতে ঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত ৮০ লাখ পরিবারের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং বিদ্যুৎ বিভাগের প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী নসরুল হামিদ।

বৈদ্যুতিক লাইনের ওপর গাছ উপড়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা শামীম হাসান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে আমরা কাজ করছি।”

বিদ্যুৎ সংযোগ কাঠামো কুমিল্লা জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনার বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন নিরলস কাজ করছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান।

“টানা ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার পর মঙ্গলবার দুপুর একটায় কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ এসেছিল। তারপর আবার চলে যায়। এখন বিকেলে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি,” বেনারকে জানান বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা হাসান ঝন্টু।

মারা গেছেন অন্তত ২৪ জন

বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন সিত্রাং উপকূলীয় ১৫ জেলার উপর আঘাত হেনে প্রাণ এবং সম্পদের অনেক ক্ষতি করেছে।

বেনার নিউজ বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের প্রধান ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছে। তাঁরা দেশের ১২টি জেলায় অন্তত ২৪ জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে একজন মিয়ানমারের নাগরিক। যদিও দেশের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো মৃতের সংখ্যা ৩৫ বা তার চেয়ে বেশি উল্লেখ করেছে।

চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ লাবিব আবদুল্লাহ মঙ্গলবার বেনারকে জানান, “মিরসরাইয়ে সোমবার রাত ১১টার দিকে বালু উত্তোলনকারী ড্রেজার উল্টে গেলে ৮ জন শ্রমিক মারা যান।”

এদিকে এক সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর থেকে টেকনাফ নদীবন্দরে আসা একটি জাহাজের বাবুর্চি মায়ানমারের নাগরিক শ মিং (৭১) নিহত হয়েছেন।

“সিত্রাংয়ের প্রবল ঢেউ আঘাত হানলে তিনি জাহাজের ডেক থেকে পানিতে পড়ে যান,” বেনারকে জানান টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি জানান, মরদেহ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান মঙ্গলবার বলেছেন, স্থানীয় জাফর আলমের ৯ বছর বয়সী মেয়ে সোহেনা সিত্রাংয়ের ধাক্কায় পুকুরে পড়ে মারা গেছে।

এছাড়া কুমিল্লার নাঙ্গোলকোট উপজেলায় একটি বাড়ির ওপর গাছ পড়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

ভোলা, ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ জেলায় দুজন করে মারা গেছেন, নড়াইল, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় মারা গেছেন একজন করে।

আরও ঝড়ের পূর্বাভাস

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেছেন, “আমরা আশঙ্কা করছি যে চলতি বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে।” আবহাওয়া অধিদপ্তর মঙ্গলবার জানিয়েছে, এটির নাম হবে ‘মানদুস’। নামটি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সোমবার রাত ১০টার দিকে সিত্রাং আঘাত হানার আগে সরকার প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করে বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, সিত্রাং ১০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ও ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি করেছে।

“আমরা আশঙ্কা করেছিলাম যে সিত্রাং বাংলাদেশে বড়ো ধরনের বিপর্যয় ঘটাবে। কিন্তু তা দুর্বল হয়ে রাত ১০টা নাগাদ উপকূলে আঘাত হানে,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “আমাদের সৌভাগ্য যে, সাইক্লোনের সময় ভাটা ছিল। এ জন্য জলোচ্ছ্বাস হয়নি। তা ছাড়া বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের ওপরে যায়নি।”

cyclone2.jpg
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জলাবদ্ধ ঢাকার একটি রাস্তা। ২৪ অক্টোবর ২০২২। [রয়টার্স]

বিড়ম্বনায় ঢাকাবাসী

“আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায়” মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে বন্দরে কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোঃ শাহজাহান।

এছাড়া, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার নৌযান চলাচলের ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। চালু হয়েছে সব বিমানবন্দর।

তবে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা এবং সড়কে গাছ পড়ে থাকায় ঢাকাবাসীকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। মঙ্গলবারও শহরের কিছু এলাকায় ছিল হাঁটুপানি। রাজধানীতে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর।

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রবল ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানলে অন্তত ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানলে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।

২০২১ সালের ২১ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ১৫ জনের।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।