সাত দিনে কারাগারে পাঁচ বন্দির মৃত্যু, চার জনেরই বুকে ব্যথা
2022.09.12
ঢাকা

গত রোববার থেকে শনিবার, সাত দিনে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বিরোধী দলীয় এক নেতাসহ কমপক্ষে পাঁচ বন্দির মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনই ‘বুকে ব্যথা’ থেকে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ।
এভাবে বন্দি মৃত্যুর ঘটনাগুলো “হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই,” বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।
“কেউ কারাগারে থাকলেই যে বুকে ব্যথা হতে পারবে না, এমনটি নয়। কিন্তু বন্দিদের জন্য কারাগারের পরিবেশ কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত এবং বন্দিদের পুষ্টির বিষয়টি কতটা দেখা হচ্ছে, সেটি বিবেচ্য বিষয়,” সোমবার বেনারকে বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “কারাগারে বন্দি মৃত্যুর বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে জাতির সামনে শ্বেতপত্র তুলে ধরার দাবি বারবার করা হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছে না।”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বিভিন্ন কারাগারে কমপক্ষে ৪৩জন বন্দি মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৪জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং বাকি ২৯জন বিচার বা তদন্ত মোকাবেলা করছিলেন।
সংস্থাটি বলছে, কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, ২০২১ সালে এমন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮১। তার আগে ২০২০ সালে ৭৫ এবং ২০১৯ সালে ৫৮ জন বন্দির মৃত্যু হয় বিভিন্ন কারাগারে।
সর্বশেষ, শনিবার রাতে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর বন্দি সানাউল্লাহ (৫৫)। তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন বলে বেনারকে জানান ওই কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. নুরুন্নবী ভূইঁয়া।
তার আগে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে একই কারাগারে “বুকে তীব্র ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে,” হাসপাতালে নেবার পর হাজতি আফাজ উদ্দিনের (৪০) মৃত্যু হয় বলে জানান নুরুন্নবী।
এর আগে সোমবার (সেপ্টেম্বর ৫) গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাই সিকিউরিটি কারাগারে অসুস্থ দুই বন্দির মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন; ময়মনসিংহ জেলার আবু বক্কর সিদ্দিক (৬২) ও মাদারীপুরের খোকন ব্যাপারী (৪২)।
এদের মধ্যে সোমবার সকালের দিকে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আবু বক্কর সিদ্দিক ও মাদক মামলায় বন্দি খোকন ব্যাপারী আলাদাভাবে “হঠাৎ অসুস্থ” হয়ে পড়লে দুই বন্দিকে প্রথমে কারা হাসপাতালে ও পরে নিকটবর্তী সাধারণ হাসপাতালে নেবার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদেরকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বেনারকে জানান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাই সিকিউরিটি কারাগারের ডেপুটি জেলার মো: দেলোয়ার জাহান।
“এই দুই বন্দির মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে বুকে ব্যথা থাকার কথা জানা গেছে, তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে,” বলেন দেলোয়ার।
এদিকে গত রোববার (সেপ্টেম্বর ৪) কারাগারের বন্দি মেহেরপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি তোফায়েল আহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে মেহেরপুর সদর হাসপাতালে। মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে জানিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাহাবুবুল হাসান মেহেদি সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যু হয়েছে তোফায়েলের।
তোফায়েলের মৃত্যুর ঘটনায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ অরুণ কারাগার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ এনে বলেন, আট মাস ধরে কারাগারে থাকা তোফায়েল রোববার সন্ধ্যায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নেয়নি। অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাই এটি হত্যাকাণ্ড।
তোফায়েলের মেয়ে তোছফি আক্তার দাবি করেন, তাঁর বাবাকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং পরবর্তীতে সেই মামলায় জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেরপুর জেল সুপার মোখলেছুর রহমান বেনারকে বলেন, অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়।
তোফায়েল অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথেই তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
চিন্তার কারণ `বুকে ব্যথা’
কারাগারে বন্দি মারা গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা বলা হয় জানিয়ে বিষয়টিকে উদ্বেগজনক ও চিন্তার কারণ বলছেন আসক এর নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।
বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “এই বুকে ব্যথার গল্প আমাদের কাছে নতুন নয়। এর আগে ২০০৪ সালে বিএনপি শাসনামলে অপারেশন ক্লিন হার্টে কীভাবে আসামি বা আটক ব্যক্তিরা কথিত বুকে ব্যথা নিয়ে মারা গেছেন তা আমরা দেখেছি।”
কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে লিটন বলেন, “বন্দিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বন্দিদের অপর্যাপ্ত চিকিৎসা প্রদানের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।”
গত ১১ আগস্ট কুমিল্লা কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় আনোয়ার হোসেন (৩৫) নামে এক ব্যক্তির। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, আনোয়ার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
কিন্তু ২৫ আগস্ট আনোয়ারের পরিবার সাংবাদিকদের জানান, একটি সিএনজি চুরির ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আনোয়ার এবং তাঁর ভাই জসিমকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে পুলিশ এবং সেই নির্যাতনের কারণেই মৃত্যু হয় আনোয়ারের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বেনারকে বলেন, আনোয়ারকে নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়। গ্রেপ্তারের পরপরই আদালতের মাধ্যমে আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
অভিযোগ অস্বীকার কারা কর্তৃপক্ষের
কারাগারে বন্দি মৃত্যু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “এই ধরনের অভিযোগ তোলার কোনো ভিত্তি নেই। কারাগারে বন্দিরা নির্যাতন হন-এমন অভিযোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দেয়া হয় দাবি করে তিনি বলেন, “প্রতিটি জেল হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন এবং তাঁরা রোগীদের সেবায় আন্তরিক।”
কোনো রোগীর চিকিৎসা জেল হাসপাতালে দেয়া সম্ভব না হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে বন্দিকে দ্রুত বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয় দাবি করে তিনি বলেন, “এখানে অবহেলার সুযোগ নেই, এমন অভিযোগ তোলারও সুযোগ নেই।”